ফ্লোরি রউফ কুর্দির বিবেক মেরে ফেলেছে। সে তাকে নানা গোপন তথ্য জিজ্ঞেস করছে এবং অবলীলায় সব বলে দিচ্ছে। আল-ফারেস অনেক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তিনি মাঝে-মধ্যে অন্যান্য জাহাজেও চলে যাচ্ছেন এবং খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। একদিন রউফ কুর্দি ফ্লোরির যাদুতে বিমোহিত হয়ে আবেগের আতিশয্যে বলে দেয়, জাহাজে একজন বিপজ্জনক লোক আছে। তার সঙ্গে কোনো কথা বলো না। রউফ কুর্দি এখনো মেয়েগুলোকে যাযাবরই মনে করছে এবং তাদের আসল নাম ফ্লোরি ও রোজি সম্পর্কে অনবহিত। মেয়েগুলো মূলত অভিজ্ঞ গুপ্তচর। ফ্লোরি বুঝে ফেলে, রউফ কুর্দি যার কথা বলছে, সে একজন গোয়েন্দা। ফ্লোরি জাহাজ থেকে চলে যাক, রউফ কুর্দি মেনে নিতে পারছেন না। তাই সে মেয়েগুলোকে জানিয়ে দেয়, এই লোকটি গোয়েন্দা, তোমরা তার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।
এক রাতে আল-ফারেন্স অন্য এক জাহাজে যান। মধ্যরাতে রউফ কুর্দি ও ফ্লোরি জাহাজের ছাদের উপর রেলিংয়ের সঙ্গে এমন এক স্থানে লুকিয়ে : যায়, যার পেছনে ও ডানে-বাঁয়ে অনেক মালপত্র পড়ে আছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা জ্ঞাতসারে কিংবা ঘটনাক্রমে ওদিকে চলে যায়। সে দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। রউফ কুর্দি ভীত হওয়া কিংবা মিথ্যা বুঝ দেয়ার পরিবর্তে তাকে সরিয়ে খানিক আড়ালে। নিয়ে যায় এবং বলে, মেয়েটাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলাম, তোমরা আসলে কারা। আমি চলে যাচ্ছি, তুমি তার পাশে বসে যাও এবং নিজের অভিজ্ঞতা ও বিদ্যা অনুসারে কথা বলে তার থেকে তথ্য উদ্ধার করো, তারা কারা।
গোয়েন্দাকে ফ্লোরির কাছে বসিয়ে দিয়ে রউফ কুর্দি কক্ষে গিয়ে রোজিকে জাগিয়ে তোলে। বলে, শিকার অমুক জায়গায় আছে। তুমিও চলে যাও। আমি কেউ এসে পড়ে কিনা এদিক-ওদিক দেখতে থাকি।
রোজি ছাদে আসে। রউফ কুর্দি তাকে হাত দুয়েক লম্বা একটা রশি দিয়ে দেয়। গোয়েন্দা ও ফ্লোরি যেখানে বলা আছে, রোজি সেখানে চলে যায়। জায়গাটায় অন্ধকার। রোজি আস্তে করে অদের কাছে বসে পড়ে। গোয়েন্দার গল্প-গুজবের এক ফাঁকে মোজি রশিটা তার গলায় পেঁচিয়ে ধরে। মেয়ে দুটো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফ্লোরি সঙ্গে সঙ্গে রশির অপর মাথা ধরে ফেলে। গোয়েন্দা নিজেকে রক্ষা করার জন্য হাত-পা ছোঁড়ার আগেই মেয়েরা দুদিক থেকে টান দিয়ে তার গলার ফাস শক্ত করে ফেলে। ক্ষণকাল ছটফট করে করে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
রউফ কুর্দি খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। এক কর্মচারি ওদিকে আসতে চাইলে কাজের কথা বলে তাকে সরিয়ে দেয়। মেয়ে দুটো গোয়েন্দার মৃতদেহটা সমুদ্রে ফেলে দেয়। রোজি চলে যায়। ফ্লোরি ওখানেই বসে থাকে। রউফ কুর্দি তার নিকট ফিরে আসে এবং দুজনে দুজনের মাঝে হারিয়ে যায়।
***
আল-ফারেস জানেনই না তার জাহাজে কোনো গোয়েন্দা এসেছে কিবা রউফু কুর্কি নতুন কাউকে চাকরিতে নিয়োগদান করেছে। গোয়েন্দার হত্যাকাস্ত্রে তিন-চার দিন পর আল-ফারেসের মনে ভাবনা জাগে, নিজের ও অন্যান্য জাহাজের মাল্লা ও সৈনিকরা মাসের পর মাস সমুদ্রে নিরানন্দ জীবন-যাপন করছে এবং এতো দিনে সবাই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠেছে। অন্যান্য জাহাজে গিয়ে তিনি মাল্লা ও সৈনিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। কারোরই মন ভালো নেই। মাঝে-মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলেও তাদের মনের অবস্থা অন্তত এরূপ হতো না। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঈমানদীপ্ত দান করেন, কোনো এক রাতে সবাইকে একত্রিত করে একটা বিনোদন ও ভোজসভার আয়োজন করবেন।
আল-ফারেস রউফ কুর্দি এবং অন্যান্য অধীন অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন। আলোচনার সময় মেয়ে দুটোও উপস্থিত ছিলো। তারা খুশিতে আটখানা হয়ে বললো, আমরা নাচবো। আল-ফারেস প্রাণোচ্ছল ফুর্তিবাজ মানুষ। তিনি মেয়েদের প্রস্তাব গ্রহণ করে নেন। তবে অনুষ্ঠান কোন্ রাতে হবে এখনো ঠিক করেননি। কারণ, তিনি স্থল থেকে সুলতান আইউবীর দূতের অপেক্ষা করছেন। সময়টা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ।
দুদিন পর দূত এসে পৌঁছে। জানায়, সুলতান আইউবী টায়ের থেকে সামান্য দূরে এসে অবস্থান নিয়েছেন। আপনি বহর নিয়ে টায়েরের কাছাকাছি চলে যান, যাতে প্রয়োজনের সময় দ্রুত টায়ের পৌঁছে যেতে পারেন। দূত বিশেষভাবে সতর্ক করে, এখন দিন-রাত সব সময় চৌকস থাকতে হবে। কেননা, খৃস্টান রণতরীগুলো নিকটেই অবস্থান করছে। আল-ফারেস দূতকে বিদায় দিয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় বিক্ষিপ্ত জাহাজগুলোকে এক স্থানে একত্রিত করার ইঙ্গিত দিয়ে দেন। তিনি রউফ কুর্দিকে জানান, সম্ভবত দিন কয়েকের মধ্যেই আমাদেরকে নৌযুদ্ধ লড়তে হবে। কাজেই, অনুষ্ঠানটা দুরাত পরই আয়োজন করে ফেললে ভালো হয়।
রউফ কুর্দি মেয়েদেরকে জানিয়ে দেয়, অমুক রাত জাহাজগুলো একত্রিত হবে এবং আমাদের বিনোদন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
এন্ড্রুর আসা-যাওয়া অব্যাহত রযেছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা তাকে কয়েক জায়গায় দেখেছিলো। এখন যখন জাহাজগুলো কূলে এসে ছিঁড়ে, তো এ এসে পড়ে। মেয়েরা যথারীতি তাকে উপরে তুলে আনে এবং কেনাকাটার ছলে তার কানে তথ্য দিয়ে দেয়, অমুক রাত জাহাজগুলো একত্রিত হবে এবং এই জাহাজের ছাদে বিনোদন অনুষ্ঠান হবে। সে এই বলে চলে যায় যে, সে রাতে আমার ডিঙ্গি আসবে। তোমরা সিঁড়ি ফেলে আমাকে উপরে তুলে নেবে।