সুলতান আইউবী এই পণ আদায় করে বাইতুল মুকাদ্দাস ত্যাগ করার মেয়াদ চল্লিশ দিন নির্ধারণ করেন। চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কয়েক হাজার গরীব-অসহায় খৃস্টান নগরীতে রয়ে যায়। নব্বই বছর আগে খৃস্টানরা যখন বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করেছিলো, তখন দূর-দূরান্ত থেকে খৃস্টানরা সেখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো। কোনদিন আবার সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, তাদের কল্পনায়ও ছিলো না। এই অবস্থা দেখে সুলতান আইউবীর ভাই আল-আদিল সুলতানের নিকট আসেন।
সুলতানে মুহতারাম!- আল-আদিল বললেন- আপনি জানেন এই নগরী জয়ে আমার ও আমার সেনা ইউনিটের অবদান কততখানি। তার বিনিময়ে গোলাম হিসেবে আমাকে এক হাজার খৃস্টান দান করুন।
এতো গোলাম কী করবে? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।
আমি যা খুশি করবো।
সুলতান আইউবী আল-আদিলকে এক হাজার খৃস্টান দিয়ে দেয়ার আদেশ দেন। অনুমোদন পেয়ে আল-আদিল এক হাজার খৃস্টান নির্বাচন করে তাদেরকে ফটকের নিকট নিয়ে মুক্ত করে দেন।
মহামান্য সুলতান!- আল-আদিল ফিরে এসে সুলতান আইউবীকে বললেন- আমি সে সকল নাগরিককে নগরী থেকে বিদায় করে দিয়েছি। তাদের কাছে পণ আদায় করার মতো অর্থ ছিলো না।
আমি জানতাম তুমি এমনই করবে- সুলতান আইউবী বললেন অন্যথায় আমি তোমাকে একটি গোলামও দিতাম না। মানুষ মানুষের গোলাম হতে পারে না। আল্লাহ তোমার এই পুণ্য কবুল করুন।
এসব কাহিনী রূপকথা নয়। ঐতিহাসিকদের বর্ণিত বাস্তব সত্য। তারা লিখেছেন, একদল খৃস্টান মহিলা সুলতান আইউবীর নিকট আসে। জানা গেলো, এরা নিহত কিংবা বন্দি হওয়া খৃস্টানদের স্ত্রী, কন্যা, বোন। এদের কাছে পণ আদায় করার অর্থ নেই। সুলতান আইউবী তাদেরকে শুধু মুক্তই করে দেননি, বরং প্রত্যেককে কিছু কিছু করে অর্থ দিয়ে বিদায় করে দেন। তারপর তিনি ঘোষণা দেন, এখনো যেসব খৃস্টান নগরীতে রয়ে গেছে, তাদের পণ মাফ করে দেয়া হলো। তারা এমনিতেই চলে যেতে পারে। বাইতুল মুকাদ্দাসে শুধু খৃস্টান বন্দিরাই অবশিষ্ট থাকে।
ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী মসজিদ পরিচ্ছন্ন ও মেরামতের কাজ সম্পন্ন করে ফেলেন। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, মেরামত কাজে সুলতান স্বয়ং ইট-পাথর বহন করেছিলেন। ১১৮৭ সালের ১৯ অক্টোবর শুক্রবার সুলতান আইউবী জুমার নামায আদায়ের জন্য মসজিদে আকসায় গমন করেন। নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রস্তুতকৃত মিম্বরটি তাঁর সঙ্গে। তিনি নিজ হাতে মিম্বরটি মসজিদে রাখেন। দামেশক থেকে আসা এক খতীব জুমার খুতবা পাঠ করেন।
এবার সুলতান আইউবী মসজিদের সাজসজ্জার প্রতি মনোনিবেশ করেন। মেঝেতে মর্মর পাথর স্থাপন করেন এবং মনের মতো করে মসজিদটি সুদৃশ্য করে তোলেন। সুলতান আইউবী নিজ হাতে যে সুন্দর সুন্দর পাথরগুলো স্থাপন করেছিলেন, আজও সেসব মসজিদে আকসায় বর্তমান রয়েছে এবং তার সৌন্দর্য এতোটুকুও বিনষ্ট বা বিকৃত হয়নি। এখনো সেদিনেরই ন্যায় চকচক করছে।
***
বায়তুল মুকাদ্দাস জয় ইসলামের ইতিহাসের বিরাট এক ঘটনা এবং এক সুমহান কীর্তি। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জিহাদ এখনো শেষ হয়নি। তার আরব ভূখণ্ড ও ফিলিস্তীনকে খৃষ্টানদের থেকে মুক্ত করতে হবে। বাইতুল মুকাদ্দাসকে তিনি একদিকে যেমন ইসলামী শক্তির শক্ত এক ঘাঁটিতে পরিণত করেন, তেমনি এই পবিত্র স্থানটিকে ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্রের রূপদান করেন। ৫৮৩ হিজরীর ৫ রমযান মোতাবেক ১১৮৭ খৃস্টাব্দের ৮ নবেম্বর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে রওনা হন। গতি তাঁর উত্তর দিকে। তিনি পুত্র আল মালিকুয যাহিরকে- যিনি অন্য কোথাও অবস্থান করছিলেন- বার্তা প্রেরণ করেন, তুমি তোমার সঙ্গীদেরসহ আমার নিকট চলে আসো। সুলতান টায়েরের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। এটি ক্রুসেডারদের একটি শক্ত ক্যাম্প এবং বন্দর অঞ্চল। সুলতান নৌবাহিনীর কমান্ডার আল-ফারেসকে বার্তা পাঠান, যেনো তিনি টায়েরের খানিক দূরে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সুলতান যখন এই নগরীটা আক্রমণ করবেন, তখন যেনো তিনি খৃস্টান নৌবহরের উপর আক্রমণ চালান। সুলতান আইউবী আল ফারেসকে যে দিনটির কথা বলেন, সেটি ডিসেম্বরের শেষ কিংবা জানুয়ারির শুরুর দিককার কোনো একটি দিন ছিলো।
মেয়ে দুটো আল-ফারেসের জাহাজে অবস্থান করছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর প্রেরিতে গোয়েন্দা জাহাজে নেই। হাসান বাইতুল মুকাদ্দাসের যুদ্ধ এবং বিজয় পরবর্তী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এদিক থেকে অবসর হলে তার মনে পড়ে, আল-ফারেসের জাহাজে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছিলেন। লোকটি কী করছে জানার জন্য তিনি রউফ কুর্দির নিকট একজন দূত প্রেরণ করেন। দূতের জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছুতে কয়েকদিন লেগে যায়। রউফ কুর্দি দূতকে জানায়, সেই গোয়েন্দা অনেক দিন হলো চলে গেছে।
কিন্তু গোয়েন্দা এতোক্ষণে রোম উপসাগরে মাছের পেটে হজম হয়ে। গেছে। রউফ কুর্দি তার এই পরিণতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানে। দিন কয়েক আগে গোয়েন্দা রউফ কুর্দিকে বলেছিলো, আমি এই মেয়েগুলোকে এখানে থাকতে দেবো না। সে দেখেছে, জাহাজ যখন কূলে গিয়ে নোঙ্গর ফেলে, তখন ছোট ছোট অনেক ডিঙ্গি তার নিকটে এসে পড়ে এবং মৎস্য শিকারীরূপী অনেক লোক নানা জিনিস বিক্রি করে। তাদের একজনকে সে কয়েক জায়গায় দেখেছে। মেয়ে দুটো তাকে রশির সিঁড়িতে করে উপরে তুলে আনে এবং কিছু ক্রয় করার পরিবর্তে তার সঙ্গে কথা বলে। জাহাজ যখন দশ-পনের মাইল দূরে কূলে কোথাও অবস্থান করে, তখনো এই লোকটি ডিঙি নিয়ে এসে পড়ে। এই নোকটার প্রতি গোয়েন্দার সন্দেহ জমে যায়।