দীর্ঘ অমানুষিক নির্যাতনে নিষ্পিষ্ট মুসলমানরা চীৎকার করে করে তাকবীর ধ্বনি দিতে থাকে। অনেকে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। অশ্রু নেমে আসে সকলেরই চোখে। সে এক আবেগঘন ও বেদনাবিধূর দৃশ্য। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ মোতাবেক সুলতান আইউবী এতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে, জনতার ধ্বনির উত্তরে তিনি হাত দুটো উঁচু করে নাড়াতে থাকেন ঠিক, কিন্তু ঠোঁটে হাসির বাম্পও ছিলো না। বরং তিনি উভয় ঠোঁট একত্রিত করে দাঁতে চেপে ধরে আবেগ দমন করার এবং হেঁচকি প্রতিহত করার চেষ্টা করছিলেন।
খৃস্টান নাগরিকরা নিজ নিজ ঘরে নিস্তব্ধ বসে ভয়ে কাঁপতে থাকে। তারা তাদের যুবতী কন্যাদেরকে লুকিয়ে ফেলে। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, অনেকে মেয়েদেরকে পুরুষের পোশাক পরিয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস হিলো, মুসলিম সৈনিকরা মুসলিম নারীদের অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তাদের মেয়েদের লাঞ্ছিত করবে। কিন্তু ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেনপোল লিখেছেন, সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী যখন খৃষ্টান বাহিনী থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস নগরীর দখল বুঝে নিচ্ছিলো, তখন তিনি যে পরিমাণ উদারতা ও উন্নত চরিত্রের স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তেমনি অতীতে কখনো করেননি। তাঁর নির্দেশে তার বাহিনীর সৈন্য ও অফিসারগণ নগরীর শান্তি ও সকলের নিরাপত্তার জন্য রাস্তায়-গলিতে টহল দিতে নেমে পড়েছিলো। কোনো মুসলিম নাগরিক যেনো কোনো খৃস্টান নাগরিকের উপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ না করে বসে, সেদিকে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। তবে কোনো খৃস্টান নাগরিকের নগরী থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিলো না।
সুলতান আইউবী সর্বপ্রথম মসজিদে আকসায় গমন করেন। আবেগের আতিশয্যে তিনি মসজিদের বারান্দায় যেনো উপুড় হয়ে পড়ে যান। তিনি মসজিদের বারান্দাতেই সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ ও আহমদ মিসরীর বর্ণনা মোতাবেক সুলতান আইউবীর চোখ থেকে এমন ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করে, যেন তিনি এই মহান মসজিদটি চোখের পানিতে ধৌত করছিলেন।
মসজিদের অবস্থা ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়। কয়েকজন মুসলিম শাসক আপন আপন শাসনামলে মসজিদে সোনা-রূপার ঝাড়বাতি ও দীপাধার স্থাপন করেছিলেন। তারা ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ মসজিদে নানা রকম মূল্যবান উপহার সামগ্রীও রেখেছিলেন। খৃস্টানরা সে সকল ঐতিহ্যবাহী মূল্যবান সম্পদ ও স্মৃতি চিহ্নগুলো তুলে নিয়ে গেছে। মসজিদের মেঝে থেকে স্থানে স্থানে মর্মরের পাত উধাও হয়ে গেছে। মেরামত ছাড়া মসজিদটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছিলো।
মসজিদ মেরামতের প্রতি মনোনিবেশ করার আগে সুলতান আইউবী পরাজিত খৃস্টানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি মনে করেন। তিনি উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নির্দেশ জারি করেন, প্রতিজন খৃস্টান। পুরুষ দশ দিনার, মহিলারা পাঁচ দিনার এবং শিশুরা এক দিনার করে পণ আদায় করে নগরী থেকে বেরিয়ে যাবে। একজন খৃস্টানও সেখানে থাকতে প্রস্তুত ছিলো না। দীর্ঘদিনের অপরাধবোধ তাদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বেরিয়ে যেতে তাড়া করে ফিরছিলো। পশ্চিম দিককার ফটক খুলে দিয়ে সেখানে পণ আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খৃস্টানরা বেরিয়ে যেতে শুরু করে। সর্বপ্রথম খৃস্টান নেতা বালিয়ান নগরী থেকে বের হয়। তার নিকট ইংল্যান্ডের রাজা হেনরির প্রেরিত বিপুল অর্থ ছিলো। সেখান থেকে ত্রিশ হাজার দিনারের বিনিময়ে সে দশ হাজার খৃস্টানকে মুক্ত করে নেয়।
ফটকে বাইতুল মুকাদ্দাস ত্যাগকারী খৃস্টানদের ভিড় জমে যায়। তারা গোটা পরিবারের পণ আদায় করে করে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বিজিত নগরীকে বিজয়ী বাহিনীর নির্বিচার লুণ্ঠন করা একটি সাধারণ নিয়ম। বাইতুল মুকাদ্দাস তো সেই নগরী, যেখানে জয়লাভের পর খৃস্টানরা মুসলমানদের গণহত্যা করেছিল, তাদের বাড়ি-ঘর লুট করেছিলো, যুবতী কন্যা ও মসজিদগুলোর অবমাননা করেছিলো। কিন্তু সেই বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করার পর লুটপাটের পরিবর্তে সুলতান আইউবীর বাহিনী এবং বাইরে থেকে তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যাওয়া মুসলিম ব্যবসায়ীগণ খৃস্টানদের ঘরের মালামাল ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করে নেয়, যাতে : তারা পণ আদায় করে বেরিয়ে যেতে পারে। এতে সেই খৃস্টান পরিবারগুলোও মুক্তি পেয়ে যায়, যাদের নিকট পণ আদায় করার মতো নগদ অর্থ ছিলো না।
বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রধান প্যাট্রিয়ক হারকিডলেস দেখান ভিন্ন এক চরিত্র। তিনি সকল গীর্জার সঞ্চিত অর্থ একা কুক্ষিগত করে ফেলেন। গীর্জাগুলোর সোনার পেয়ালা ও অন্যান্য মূল্যবান বস্তু-সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যান। বর্ণিত আছে, এই সম্পদ এতো বেশি ছিলো যে, তার বিনিময়ে কয়েক হাজার গরীব খৃস্টান পরিবারকে মুক্ত করা যেতো। কিন্তু তাদের বড় পাদ্রী একজনেরও পণ আদায় করেননি। শুধু নিজের পণটুকু আদায় করে বেরিয়ে যান। একজন মুসলিম সৈনিক টের পেয়ে যায়, লোকটা বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে। তার রিপোের্ট মোতাবেক এক কর্মকর্তা সুলতান আইউবীকে বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু সুলতান আইউবী বললেন- সে যদি পণ আদায় করে থাকে, তাহলে তাকে বাধা দিও না। আমি কারো থেকে অতিরিক্ত মূল্য নিতে বারণ করে দিয়েছি। আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারি না।