সুলতান আইউবী তাদের স্বাগত জানান এবং তাঁবুতে নিয়ে বসান। দলনেতা বালিয়ান কথা শুরু করে। আপনি অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে যান। সুলতান আইউবী শর্ত আরোপ করেন। আসলে খৃস্টানরা বাইতুল মুকাদ্দাসের দখল ছাড়তে চাচ্ছে না। আর সুলতান আইউবীও বাইতুল মুকাদ্দাস না নিয়ে নড়তে রাজি নন। অথচ তার একজন সৈনিকও এ পর্যন্ত নগরীতে প্রবেশ করতে পারেনি। তিনি এখনো দাবি করতে পারছেন না, তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করে ফেলেছেন। খৃস্টানরা এখনো বলতে পারে, বাইতুল মুকাদ্দাস তাদের দখলে।
একদিকে সন্ধির আলোচনা চলছে, অপরদিকে অবরোধ যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। সুলতান আইউবী আলোচনা ও সন্ধি চুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তিনি আলোচনার সঙ্গে যুদ্ধও অব্যাহত রেখেছেন। প্রাচীরের ছিদ্র এখন বিস্তৃত হয়ে গেছে। মুসলিম জানবাজরা বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ অতিক্রম করে এবং প্রাচীরভাঙা পথে ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে। কিন্তু খৃস্টানদের দৃঢ় প্রত্যয়, তারা নগরী হাতছাড়া করবে না। তারা উভয় স্থান থেকে আক্রমণকারীদের বাইরে ঠেলে দেয়। বাইরে থেকে সৈন্যরা স্রোতের ন্যায় এগিয়ে যায়। সম্মুখভাগের সৈনিকরা খৃস্টানদের তীব ও বর্শার আঘাতে লুটিয়ে পড়ে। পেছনের সৈনিকরা তাদের পদপৃষ্ঠ করে করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে থাকে। অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এক জানবাজ নগরীর প্রধান ফটকের উপর লাল ক্রস খচিত পতাকাটা সরিয়ে সেখানে ইসলামী পতাকা উড়িয়ে দেয়। খৃষ্টান জনসাধারণ এমন হুলস্থুল শুরু করে দেয় যে, তারা সৈন্যদের জন্য প্রতিবন্ধক ও সমস্যারূপে আবির্ভূত হয়।
সুলতান আইউবীর জানবাজরা পাগলের মতো হয়ে গেছে। তাদের কতিপয় মসজিদে আকসায় ঢুকে উপর থেকে ক্রুশটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে। সেখানেও ইসলামী পতাকা উড়তে শুরু করে। কিন্তু নগরীতে উভয় বাহিনী ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, ক্রুসেডারদের হিংস্রতা ও প্রতিরোধ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে।
***
সুলতান আইউবী খৃস্টান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সন্ধির আলোচনা করছেন। বাইরের এবং নগরীর ভেতরের নতুন কোনো সংবাদ এখনো তিনি জানেন না। তিনি বালিয়ানকে বললেন- আমি বাইতুল মুকাদ্দাসকে শক্তির জোরে মুক্ত করবো বলে কসম খেয়েছি। আপনারা যদি নগরীটা আমাকে এমনভাবে দিয়ে দেন, যেনো আমি জয় করেছি, তাহলে সন্ধি করা যেতে পারে।
সালাহুদ্দীন!- বালিয়ান খানিকটা হুমকির সুরে বললো- এ নগরীর নাম এখনো জেরুজালেম- বাইতুল মুকাদ্দাস নয়। আপনি যদি সন্ধি করতে সম্মত না হন, তাহলে আমরা আপনাকে বাধ্য করবো না। তবে শুনে রাখুন, এই নগরীতে আপনার চার হাজার সৈনিক আমাদের যুদ্ধবন্দি আছে। আমাদের কাছে আটক সাধারণ মুসলমান কয়েদির সংখ্যা তিন হাজার। আমরা এই প্রত্যেক কয়েদি এবং নগরীর প্রতিজন মুসলিম অধিবাসীকে- চাই সে নারী হোক কিংবা শিশু, যুবক হোক বা বৃদ্ধ-হত্যা করে ফেলবো।
রাগে-ক্ষোভে সুলতান আইউবীর চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। কিছু বলতে উদ্যত হলেন। এমন সময় তাঁবুর পর্দা ফাঁক হয়ে যায়। তাঁর এক কমান্ডার এসেছে। সুলতান তাকে ইঙ্গিতে কাছে ডেকে নেন। কমান্ডার সুলতানের কানে ফিসফিস শব্দে বললো নগরী জয় হয়ে গেছে। প্রধান ফটক ও মসজিদে আকসার উপর ইসলামী পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
সুলতান আইউবী বালিয়ানের হুমকির জবাব পেয়ে গেছেন। তাঁর রক্তজবার ন্যায় লাল চোখে অস্বাভাবিক এক ঝিলিক ভেসে ওঠে। তিনি সজোরে নিজের উরুতে চাপড় মেরে খৃস্টান নেতা বালিয়ানকে বললেন বিজেতা পরাজিতের সঙ্গে সন্ধি আলোচনা করে না। একজন মুসলমানও আর তোমাদের কয়েদি নেই।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান আইউবী সব সময় অত্যন্ত সহনশীলতার সঙ্গে কথা বলতেন। সেদিনও একই নিয়মে বলছিলেন। কিন্তু বালিয়ানের হুমকির সঙ্গে সঙ্গে জয়ের সংবাদে তার কণ্ঠে রোষ ও গর্জন সৃষ্টি হয়ে যায়। তিনি বললেন- তোমরা সকলে আমার বন্দি। তোমাদের সমস্ত ফৌজ আমার কয়েদি। নগরীতে অবস্থানরত প্রতিজন খৃস্টান আমার কয়েদি। এই নগরী থেকে এখন একজন খৃস্টানও আমার নির্ধারিত ফি আদায় না করে বের হতে পারবে না। যাও, ভেতরে গিয়ে দেখো, ওটা জেরুজালেম নয়- বাইতুল মুকাদ্দাস।
বালিয়ান ও তার সঙ্গের খৃস্টানরা ভয় পেয়ে যায়। তবু থেকে বেরিয়ে দেখে। সুলতান আইউবীর অধিকাংশ সৈন্য ভেতরে ঢুকে গেছে। প্রধান ফটকের উপর ইসলামী পতাকা পত্ পত্ করে উড়ছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ৫৮৩ হিজরীর ২৭ রজব মোতাবেক ১১৮৭ খৃস্টাব্দের ২ অক্টোবর শুক্রবার বিজয়ী বেশে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। হতে পারে ঘটনাটা কাকতালীয় কিংবা সুলতান আইউবী পরিকল্পনাটাই এভাবে প্রণয়ন করেছিলেন অথবা মহান আল্লাহর ইচ্ছাই এমন ছিলো। একে তো শুক্রবার, সুলতান আইউবীর মহৎ কাজের মহান দিবস। তদুপরি রজবের সাতাশতম রাত। এ রাতে রাসূলে আকরাম (সা.) উক্ত স্থান থেকেই পবিত্র মিরাজে গমন করেছিলেন। সকল মুসলিম ও অমুসলিম ঐতিহাসিক বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের এ তারিখই লিখেছেন।
***
সুলতান আইউবী যখন নগরীতে প্রবেশ করেন, তখন মুসলমানরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। মহিলার মাথার ওড়না খুলে খুলে সুলতানের চলার পথে ছুঁড়ে দিয়ে সুলতানকে স্বাগত জানায়। সুলতানের দেহরক্ষীর ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ওড়নাগুলো রাস্তা থেকে তুলে নেয়।