ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নগরীতে খৃস্টানরা ভীতি, শঙ্কা, হা-হুঁতাশ ও প্রার্থনার স্থলে উল্লাসে মেতে ওঠে। সারারাত তারা গীর্জায় সমবেত হয়ে খোদাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে শুরু করে। এই সন্ধ্যা পর্যন্ত যারা নিজেদের কৃত অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করছিলো, তারা নবউদ্যমে মুসলমান নাগরিকদের উপর নিপীড়ন চালানোর পরিকল্পনা আঁটতে বসে গেছে। তিরস্কার ও গালাগাল দ্বারা তারা তার উদ্বোধন করে। মুসলমানরা স্তব্ধ, হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
পরদিন শুক্রবার। ১১৮৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। খৃস্টানরা প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো, দক্ষিণ দিকে যাইতুন পর্বতের উপর সুলতান আইউবীর পতাকা উড়ছে এবং তার সম্মুখে প্রাচীর থেকে সামান্য দূরে মুসলমানরা মিনজানিক স্থাপন করেছে ও অশ্বারোহী ও পদাতিক মিলে কমপক্ষে দশ হাজার সৈন্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুত দাঁড়িয়ে আছে। পজিশন ও প্লন পরিবর্তন করে সুলতান আইউবী জুমার দিন বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আক্রমণ চালান।
নগরীর উপর পাথর ও আগুনের গোলা পূর্বাপেক্ষা বেশি নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করেছে। তৎক্ষণাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ে, মুসলমানদের আরো বেশি ফৌজ এসে পড়েছে এবং নগরী এখন এক-দুদিনের মেহমান মাত্র। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, নগরীতে আতঙ্কের নতুন ধারা শুরু হয়ে যায়। খৃস্টানরা ঘর থেকে বের হয়ে অলি-গলি ও হাট-বাজারে হা হুতাশ শুরু করে দেয়। মুসলমানদের আযান পুনর্বার ধ্বনিত হতে শুরু করে। খৃস্টানদের করুণ অবস্থায় স্বয়ং পাদ্রীও প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তিনি ক্রুশ হাতে অলিতে-গলিতে ঘুরতে শুরু করেন। তিনিও কাঁদছেন এবং প্রার্থনা করছেন।
খৃস্টান অশ্বরোহীগণ পুনরায় বের হয়ে মুসলমানদের মিনজানিকগুলোর উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু এই যুদ্ধ এখন সুলতান আইউবী নিজে তদারক করছেন। তার অশ্বারোহী সেনারা তিন দিক থেকে খৃস্টান সৈনিকদের উপর দ্রুতগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের পিষে ফেলে। পরে খৃস্টানরা আরো দুবার বেরিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলিম সৈনিকরা তাদেরকে ফটক থেকে বেশি এগুতে দেয়নি। সুলতান আইউবী প্রথমবারের মতো সুড়ঙ্গ খনন ও প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য সম্মুখে বাহিনী প্রেরণ করেন। প্রত্যেকের হাতে একটি করে ঢাল। তারা এই ঢালের পেছনে মাথা থেকে পা পর্যন্ত লুকিয়ে লুকিয়ে এগিয়ে যায়। তাছাড়া প্রাচীরের যে অংশটির নীচে সুড়ঙ্গ খনন কিংবা প্রাচীর ভাঙা হবে, সুলতান আইউবীর তীরন্দাজ সৈন্যরা অত্যন্ত তীব্রতার সাথে তার উপর তীর ছুঁড়তে শুরু করে।
সেখানে একটি ফটক আছে, যার উপর ভবন নির্মিত আছে। সে ফটকের পেছনে অনুরূপ আরা একটি মজবুত ফটক আছে। দুই ফটকের মাঝে দেউড়ি। এই দেউড়ির উপরও একটি ভবন। সুলতান আইউবী তারই নীচে সুড়ঙ্গ খনন করাতে চাচ্ছেন। এই ফটকের একটু দূরে প্রাচীর খানিকটা দুর্বল মনে হলো। বড় মিনজানিকগুলো তার উপর কয়েক মণ ওজনের পাথর নিক্ষেপ করে চলছে। প্রাচীরটা বেশ চওড়া। কিন্তু অনবরত একই স্থানে পাথর নিক্ষেপের ফলে তাতে ফাটল ধরে যায়। পাথরের বিস্ফোরণ নগরবাসীদের রক্ত শুকিয়ে ফেলতে শুরু করে।
দিনের বেলা বাহিনী ঢালের আড়ালে ও তীরের ছায়ায় ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এখন উপর থেকে তাদের উপর তীর ছোঁড়া হচ্ছে না। রাতে কয়েকশ জানবাজ মিলে দেউড়ির নীচে ত্রিশ গজ লম্বা সুড়ঙ্গ খনন করে ফেলে, যা দেউড়িরই সমান চওড়া। এই সুরঙ্গের মধ্যে ঘাস ও শুকনো কাঠ ভরে তার উপর তরল দাহ্য পদার্থ ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। জানবাজ সেনারা সেখান থেকে সরে আসে।
আগুনে সবকিছু পুড়ে ভষ্ম হয়ে যায়। উপর থেকে ভবনটাও ধসে পড়তে শুরু করে। একসময় ভয়ঙ্কর শব্দ করে ভবনটি পড়ে গুঁড়িয়ে যায়। ওদিকে প্রাচীরের উপর যে স্থানে ভারী ভারী পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছিলো, সেখানেও প্রাচীর ভেঙে পথ বেরিয়ে আসে। এবার ধ্বংসাবশেষের উপর দিয়ে অতিক্রম করে নগরীতে প্রবেশ করার পালা। কিন্তু এ বড় বিপজ্জনক পদক্ষেপ। ধ্বংসাবশেষ সরানোর অভিযান শুরু হয়ে যায়।
নগরীর গীর্জাগুলোর ঘণ্টা আরো জোরে বাজতে শুরু করেছে। সুললিত আযানের পবিত্র ও জয়সূচক ধ্বনিও তীব্র হয়ে ওঠেছে। খৃস্টান সেনাপতি-সম্রাটদের মনোবলেও ভাটা এসে পড়েছে। তারা বৈঠকে বসেছেন। সেনাপতিরা প্রস্তাব পেশ করেছে, সৈন্য ও স্বেচ্ছাসেবী জনসাধারণ সকলে মিলে একযোগে বাইরে বেরিয়ে সুলতান আইউবীর বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু পোপ এ প্রস্তাব এই বলে নাকচ করে দেন যে, এ পন্থা অবলম্বন করলে নগরীতে শুধু নারী ও শিশুরা রয়ে যাবে, যারা মুসলমানদের প্রতিশোধের শিকারে পরিণত হবে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তারা সুলতান আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করবে। এক খৃস্টান নেতা বালিয়ানকে এ কাজে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়।
বাইরে থেকে সুলতান আইউবীর সৈন্যরা দেখে, ফটকের বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষের উপর সাদা পতাকা উড়ছে। তীরন্দাজদের থামিয়ে দেয়া হলো। পতাকার সঙ্গে তিন-চারজন লোকও আত্মপ্রকাশ করে। একজন উচ্চস্বরে বললো- আমরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। সুলতান আইউবী ঘোষণাটা শুনলেন। বললেন ওদেরকে নিয়ে আসো।