মুসলমান অধিবাসীদের অবস্থা ছিলো ভিন্ন রকম। তিন হাজারের অধিক মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশু বন্দি ছিলো। যারা বাড়ি-ঘরে ছিলো, তারা নজরবন্দির জীবন-যাপন করছিলো। খৃস্টানদের ভয়ে তারা মসজিদে যেতো না। সকল মুসলমান জেনে ফেলেছে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেছেন। খৃস্টানদের ভীতি ও কাপুরুষতা দেখে কয়েকটি উত্তেজিত মুসলিম যুবক বাড়ির ছাদে ওঠে আযান দিতে শুরু করে। মহিলারা ঘরে-কারাগারে যে যেখানে ছিলো, মহান আল্লাহর– দরবারে কাকুতি-মিনতি ও দুআ-দরূদ পাঠ করতে শুরু করে।
খৃস্টানরা তাদের দেখেও নিপ থাকে। কেউ কিছু বলছে না। কারণ, তারা বুঝে গেছে, তারা মুসলমানদের উপর যে নিপীড়িন চালিয়েছিলো, তার শাস্তি শুরু হয়ে গেছে। এখন অনাগত শাস্তির ভয়েই তারা কাঁপছে। তাই এখন মুসলমানদের কোনো কাজে বাধা দেয়ার হিম্মত তাদের নেই। খৃস্টানদের এই মনোভাব আন্দাজ করে মুসলিম যুবকরা অলি-গলিতে চীৎকার করতে শুরু করে ইমাম মাহদী এসে পড়েছেন। আমাদের মুক্তিদাতা এসে গেছেন। তিনি নগরীর দেয়ালের উপর দিয়ে আসছেন। ফটক ভেঙে আসছেন।
নগরীর ভেতরে হক ও বাতিলের, গীর্জার ঘণ্টা ও আযান ধ্বনির সংঘর্ষ চলছে। বাইরে চলছে ঘোড়া, তরবারী ও তীর-বর্শার যুদ্ধ। খৃস্টানদের গীর্জাগুলোতে প্রার্থনা গীতও উচ্চ হচ্ছে। সেই তালে তালে কুরআন তিলাওয়াতের সুরও উঁচু হচ্ছে। অবুঝ শিশুরাও মহান আল্লাহর দরবারে সেজদায় অবনত হয়ে আছে।
কিন্তু বাইরে সুলতান আইউবী এখনো কোথাও থেকে প্রাচীর ভাঙার কিংবা সুড়ঙ্গ খনন করার ব্যবস্থা করে ওঠতে পারেননি। প্রাচীরের উপর থেকে বাইরের দিকে মুষলধারা বৃষ্টির ন্যায় তীর আসছে। মিনজানিক চালনাকারী ও পাথর বহনকারী মুসলিম সৈনিকদের হাত থেকে রক্ত ঝরছে। বর্মপরিহিত নাইটরা এখনো থেকে থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করছে এবং যানপরনাই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়ে ফিরে যাচ্ছে।
***
চল্লিশ মাইল দূরে রাম উপসাগরে আল-ফারেস বায়দারীনের ছয়টি জাহাজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টহল দিয়ে ফিরছে। উদ্দেশ্য, যাতে টায়েরে অবস্থানরত খৃস্টানদের নৌবহর সৈন্য ও সরঞ্জামাদি নিয়ে আসতে না পারে। মেয়ে দুটো তার জাহাজে আছে। কিন্তু বর্তমানে তিনি তাদের প্রতি মনোনিবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। নৌ-বাহিনী প্রধান আল-মুহসিন তার উপর অতিশয় স্পর্শকাতর দায়িত্ব অর্পণ করে রেখেছেন। কখনো কখনো নিজে মাস্তুলের উপর পাতা মাচানে উঠে দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত গভীর চোখে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করছেন। অন্যান্য জাহাজে গিয়েও খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, যাতে কেউ দায়িত্বে অবহেলা না করে।
এদিকে নায়েব রউফ কুর্দি ফ্লোরির সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, যা এখন অনেকটা গোপন অভিসারের রূপ লাভ করেছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা উভয়ের প্রতি গভীর দৃষ্টি রেখে চলছে।
মিসরে নৌবহর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত টহল দিচ্ছে। আশঙ্কা আছে, ইউরোপ থেকে বিশেষত ইংল্যান্ড থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করার জন্য সাহায্য আসবে। সুলতান আইউবীর ঝড়গতির অগ্রযাত্রা এবং খৃস্টানদের প্রতিটি দুর্গ ও নগরীর উপর সফল আক্রমণের প্রেক্ষিতে তারা জার্মানির সম্রাট ফ্রেডারিক ও ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ডকে এ মর্মে পত্র লিখেছে যে, আরব থেকে ক্রুশের পতন ঘটছে এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করা কঠিন মনে হচ্ছে। তোমরা আসো, আমাদেরকে সাহায্য করো। বাইতুল মুকাদ্দাসের যুদ্ধ রোম উপসাগরেও অনুষ্ঠিত হোক এবং যুদ্ধ অনেক ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করুক, তা সুলতান আইউবীর কাম্য। কিন্তু জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে কোনো তৎপরতার সংবাদ আসছে না। পরাজিত খৃস্টান বাহিনীর নৌবহর টায়েরের বন্দর অঞ্চলে চুপচাপ বসে আছে। তথাপি সুলতান আইউবীর নৌবাহিনী প্রধান দুশমনের নৌবাহিনীর এই নীরবতাকে বিপদের পূর্ব সংকেত মনে করছেন। তাই তিনি পূর্ণ সতর্ক রয়েছেন।
***
অবরোধের চতুর্থ রাত। এখনো কোনো সফলতা অর্জিত হয়নি। খৃস্টান ও অন্যান্য অশ্বারোহী সেনারা বাইরে এসে অত্যন্ত দুঃসাহসী আক্রমণ চালাচ্ছে এবং মানুষ ও পশুদের জীবনহানির ঝুঁকি বরণ করছে। চার দিনের আহত ও শহীদদের হিসাব নেয়ার পর সুলতান আইউবীর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। তার অস্ত্র ও সরঞ্জামের অভাব নেই। বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে তিনি দীর্ঘ যুদ্ধ লড়ার জন্য বিপুল অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে নিয়েছেন। তার অভাব শুধু লোকের। সেনাসংখ্যা দ্রুতগতিতে কমে যাচ্ছে এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রাচীর তার জন্য যথারীতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পঞ্চম দিন সুলতান আইউবী পশ্চিম দিককার ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেন এবং সেখানকার যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। দক্ষিণ দিকে এক স্থানে প্রাচীর দুর্বল পেয়েছেন। পশ্চিম দিক থেকে মিনজানিকগুলো সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং দূরে পেছনে যে তাঁবু স্থাপন করা ছিলো, সেগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। চিত্রটা এমন, যেনো সুলতান আইউবী অবরোধ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। প্রাচীরের উপর যেসব খৃস্টান নাগরিক ছিলো, তারা নগরীতে সংবাদ ছড়িয়ে দেয়, অবরোধ উঠে গেছে এবং মুসলিম সৈন্যরা পেছনে সরে যাচ্ছে। সুলতান আইউবী প্রাচীর থেকে দূরে বাহিনীকে স্থানান্তরিত করছেন।