তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা এক নজর দেখে জলপাম্ভীর কণ্ঠে গর্জে উঠলেন আইউবী–
আমার পথ থেকে ফুলগুলো সরিয়ে নাও। ফুল মাড়িয়ে গেলে ও-ফুলের কাটা আমার হৃদয়টাকে ঝাঁঝরা করে দেবে। আমার পথের তরুণীদের হটাও। আমি চাইনা ওদের রেশমী চুলে আটকে পড়ে আমার তরবারী অকেজো হয়ে যাক।
আর আমাকে কখনও হুজুর কেবলা বলে সম্বোধন করবেন না। কঠোর ঝাঝের স্বরে বললেন আইউবী। তাঁর তিরস্কারে যেন অফিসারদের দেহ থেকে মাথাগুলো সব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
হুজুর কেবলা তো তিনি, যার আনীত কালেমা পড়ে আমরা সবাই মুসলমান হয়েছি। এই অধম তার নগণ্য অনুগত উম্মত মাত্র। আমি তার পয়গাম বুকে ধারণ করেই মিসর এসেছি। তার আদর্শ রক্ষায় আমি আমার জীবন কোরবান করেছি। খৃষ্টানরা আমার বুক থেকে এই পবিত্র পয়গাম ছিনিয়ে নিতে চায়, মদের জোয়ার রোম সাগরে ডুবিয়ে দিতে চায় ইসলামের ঝাণ্ডা। আমি আপনাদের বাদশা হয়ে আসিনি–এসেছি ইসলামের একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক হয়ে।
নাজির ইশারায় তরুণীরা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আড়াল হয়ে গেলো। দ্রুতপায়ে হলরুমে প্রবেশ করলেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
রাজকীয় দরবার হল। মাঝখানে এক লম্বা টেবিলে থোকা থোকা ফুলের তোড়া। দীর্ঘ চওড়া টেবিলের চারপাশে সাজানো রাজসিক খাবার। আস্ত মুরগী, খাসির রান, দুম্বার বক্ষদেশের মোলায়েম গোশতের রকমারী আয়োজন। কক্ষময় খাবারের মৌতাত গন্ধ।
টেবিলের এক পার্শ্বে রক্ষিত সালাহুদ্দীনের জন্যে বিশেষ আসন। আইউবী দৃঢ়পদে আসনের পাশে দাঁড়ালেন। পাশের এক অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন
মিসরের সব নাগরিক কি এ ধরনের খাবার খেতে পায়?
না, সম্মানিত গভর্নর। সাধারণ মানুষ তো এ ধরনের খাবার স্বপ্নেও দেখে না।
তোমরা কি সে জাতির সদস্য নও, যে জাতির সাধারণ মানুষ এমন খাবার স্বপেও দেখে না?
কারো পক্ষ থেকে কোন জবাব এলো না।
এখানে ডিউটিরত যত কর্মচারী আছে, সবাইকে ডেকে ভিতরে নিয়ে এসো। এ খাবার তারা সবাই খাবে। নির্দেশের স্বরে বললেন আইউবী।
সালাহুদ্দীন একটি রুটি হাতে নিয়ে তাতে দু টুকরো গোশত যোগ করে খেয়ে নিলেন। দ্রুত আহারপর্ব শেষ করে নাজিকে নিয়ে গভর্নরের দফতরে চলে । গেলেন।
জাঁকজমকপূর্ণ গভর্নর হাউজ। দফতর নয়, যেন এক জান্নাতি বালাখানা। দাফতরিক প্রয়োজনের চেয়ে আয়েশী আয়োজন-উপকরণ-ই বেশী। দফতরের বিন্যাসে মারাত্মক বৈষম্য। গভর্নর হাউজের দাফতরিক পরিস্থিতি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন আইউবী। তার আগেই এখানে চলে আসা আলী বিন সুফিয়ান ততক্ষণে দেখে নিয়েছেন গভর্নর হাউজের খুঁটিনাটি। আইউবী নাজির কাছ থেকে জেনে নিলেন বিভিন্ন বিষয়।
দু ঘন্টা পর গভর্নর হাউজ থেকে বেরিয়ে এলো নাজি। দ্রুতপায়ে নিজের ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। এক লাফে ঘোড়ায় আরোহণ করে লাগাম টেনে ধরলেন। প্রশিক্ষিত ঘোড়া ক্ষিপ্রগতিতে চলে গেলো দৃষ্টিসীমার বাইরে।
নিঝুম রাত। নাজির খাস কামরায় জমে উঠেছে মদের আসর। মদপানে যোগ দিয়েছে নাজির একান্ত সহযোগী দুই কমাণ্ডার। আজকের আসরের আমেজ ভিন্ন। কোন নৃত্যগীত নেই। সবার চেহারা রুক্ষ। গ্লাসের পর গ্লাস ঢেলে দিচ্ছে সাকী। গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে তিনজন।
নীরবতা ভঙ্গ করে নাজি বললেন–
এসব যৌবনের তেজ, বুঝলে? ক দিনের মধ্যেই দেখবে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
অভাগা কথায় কথায় বলে–কাবার প্রভুর কসম! ইসলামী সালতানাত থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত না করে আমি বিশ্রাম নেব না।
হু! সালাহুদ্দীন আইউবী!–তাচ্ছিল্যভরে উচ্চারণ করলো এক কমাণ্ডার সে জানে না, ইসলামী সালতানাতের নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। এখন হুকুমত চালাবে সুদানীরা।
আপনি কি বলেননি, স্পেশাল বাহিনীর পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সব সুদানী?–নাজিকে জিজ্ঞেস করলো অপর কমাণ্ডার–বলেননি, যাদেরকে তিনি নিজের সৈন্য মনে করছেন, ওরা খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ঈদরৌস! আমি বরং তাকে আশ্বাস দিয়েছি, এই পঞ্চাশ হাজার সুদানী শার্দুল তাঁর আঙুলের ইশারায় খৃষ্টানদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ওদের নিশানা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। অচিরেই ওদের বিশ্বাসের প্রতীক ক্রুশ ভূলুণ্ঠিত হবে। কিন্তু–
থেমে গেলেন নাজি।
কিন্তু আবার কি? আগ্রহের সাথে জানতে চাইলো উভয় কমাণ্ডার।
নাজি বললেন, কিন্তু সে আমাকে বললো, মিসরের নাগরিকদের নিয়ে একটি সেনা ইউনিট গড়ে তুলুন। বললো, এক এলাকার মানুষের উপর সৈন্যবাহিনীকে সীমিত রাখা উচিত নয়। সে আমাদের বাহিনীর সাথে মিসরীয়দের মিশ্রণ ঘটাতে চায়।
তা, আপনি কী বললেন?
আমি তাকে বলেছি, শীঘ্রই আপনার হুকুম তামিল করা হবে। কিন্তু বাস্তবে আমি কখনই এমনটি করব না। বললেন নাজি।
সালাহুদ্দীন আইউবীর মেজাজ-মর্জি কেমন দেখলেন? নাজিকে জিজ্ঞেস করলো ঈদরৌস।
দেখেই বোঝা যায়, খুব জেদী।
আপনার অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের কাছে সালাহুদ্দীন কোন ফ্যাক্টর নয়। নতুন গভর্নর হলো তো, তাই কিছুটা গরম গরম ভাব। দেখবেন, অল্প দিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বললো অন্য কমাণ্ডার।
আমি তাঁর মনোভাব বদলাতে দেব না। আমি তাকে ঘোরের মধ্যেই রাখতে চাই। ক্ষমতার নেশায় বুঁদ করে রেখেই তাকে শায়েস্তা করবো। বললেন নাজি।