আমার বুকের শেষ রক্তফোঁটা দিয়ে হলেও তোমাকে হেফাজত করবো। তুমি আমার কাছে শেরেকোহ ও জঙ্গীর পবিত্র আমানত।
আমার জীবন ইসলামের মর্যাদার চেয়ে বেশী মূল্যবান নৃয় সম্মানিত জেনারেল! নিজের প্রতি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। ক্রুসেডারদের চক্রান্ত কালো মেঘের মত আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। নাজির হাতে চুমো খেয়ে বললেন আইউবী।
জবাবে মুচকি হাসলেন নাজি, যেন আইউবী তাকে মজার কোন কৌতুক শোনালেন।
নাজি অভিজ্ঞ অধিনায়ক। মিসরের সেনাবাহিনীর অধিপতি। তার বাহিনীতে রয়েছে পঞ্চাশ হাজার সুদানী, যারা সবাই প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। নাজির মুচকি হাসির রহস্য আইউবী বুঝতে না পারলেও এতটুকু অনুধাবন, করলেন যে, এ কৌশলী ও বিজ্ঞ সেনাপতিকে তাঁর বড় প্রয়োজন।
নাজি মিসরেই শুধু নয়–গোটা ইসলামী খেলাফতের মধ্যে একজন ধুরন্ধর প্রকৃতির সেনাপতি। নিজ দক্ষতায় পঞ্চাশ হাজার সুদানী বাহিনী দিয়ে স্পেশাল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন সে। তার অধীন সৈন্যরাই পালন করতো শাসকদের দেহরক্ষীর দায়িত্ব। মিসরের গভর্নরের দেহরক্ষীর দায়িত্বও ন্যস্ত ছিলো নাজির স্পেশাল বাহিনীর হাতে। স্পেশাল বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক নাজির অনুগত। তার নির্দেশে অকাতরে জীবন দিতে সামান্যতম দ্বিধা করে না কেউ। বিরাট বাহিনীর কর্তৃত্বের বদৌলতে নাজি মিসর ও আশ-পাশের অন্যান্য শাসকদের জন্য ছিলেন । একটি ত্রাস। শক্তিশালী সেনাবাহিনী আর কূটচালে নাজি এ অঞ্চলের মুকুটবিহীন সম্রাট। তাকে চ্যালেঞ্জ করে এমন শক্তি কারো নেই। কূটকৌশলে নাজি এমনই দক্ষ যে, সরাসরি সিংহাসনে আসীন না হলেও তাকে মনে করা হতো মসনদের কারিগর। নিজের কূটচালে নাজি ইচ্ছেমত শাসকদের ক্ষমতায় আসীন করতেন আর ইচ্ছে হলে সরিয়ে দিতো। প্রশাসনে নাজিকে বলা হতো সকল দুষ্টবুদ্ধির আধার। সালাহুদ্দীন আইউবীর কথার জবাবে নাজির মুচকি হাসির রহস্য অন্যরা হয়ত ঠিকই বুঝে নিলো। সালাহুদ্দীন অতসব গভীর চিন্তা না করলেও এতটুকু ঠিকই ধরে নিলেন, এই শক্তিধর সেনাপতিকে তার বড় বেশি প্রয়োজন।
অনেক পথ সফর করে এসেছেন মহামান্য গভর্নর! খানিক বিশ্রাম করে নিন। বললো প্রবীণ এক অফিসার।
আমার মাথায় যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, আমি সে গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য নই। এই দায়িত্ব আমার ঘুম আর আরাম কেড়ে নিয়েছে। আপনারা আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন, যেখানে কর্তব্যসমূহ আমার অপেক্ষা করছে। বললেন আইউবী।
দায়িত্ব বুঝে নেয়ার আগে আহারটা সেরে নিলে ভাল হয় না? আইউবীর উদ্দেশে বললো নাজির সহকারী।
একটু কী যেন চিন্তা করলেন আইউবী। তারপর হাঁটা দিলেন সামনের দিকে।
বিশাল এক হলরুম। আইউবীর ডানে নাজি, বায়ে নাজির সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড ঈদরৌস। আগে পিছনে সশস্ত্র দেহরক্ষী। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গার্ড অব অনার দিচ্ছে নাজির স্পেশাল বাহিনীর নির্বাচিত সদস্যরা। স্পেশাল বাহিনীর সৌকর্য, সুঠামদেহ, উন্নত হাতিয়ার, অভ্যর্থনা আর গার্ড অব অনারের বিন্যস্ত আয়োজন দেখে আইউবীর চোখ আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠলো। এমন একটি সুগঠিত বাহিনীর স্বপ্ন-ই দেখছিলেন তিনি।
কিন্তু হলের গেটে গিয়ে আইউবী স্তম্ভিত হলেন। চিন্তায় ছেদ পড়লো তাঁর। থমকে দাঁড়ালেন তিনি।
সুরম্য হলঘর। প্রবেশ পথে উন্নত গালিচা বিছানো।
দরজায় পা রেখেই মলিন হয়ে গেলো আইউবীর চেহারা। নেমে এলো বিষাদ। চার উর্বশী তরুণী তাকে দেখেই নৃত্যের ভঙ্গিতে শরীর দুলিয়ে ঝুঁকে অভিবাদন জানালো। তাদের হাতে ঝুড়িভর্তি তাজা ফুল। ফুলগুলো শৈল্পিক ভঙ্গিতে ছিটিয়ে দিতে থাকলো আইউবীর পদতলে, তার যাত্রা পথে।
তরুণীদের পরনে মিহি রেশমের সাদা ধবধবে ঘাগরী। পিঠে ছড়ানো সোনালী চুল। তাদের ঝুলেপড়া জুলফি বাড়িয়ে তুলেছে চেহারার রওনক। তরুণীদের শরীরের দ্যুতি সূক্ষ্ম কাপড়ের বাইরে ঠিকরে পড়ছে যেনো। ওদের নৃত্য-ভঙ্গিমার তালে বেজে উঠলো তবলা। সানাইয়ের সুর। সঙ্গীতের মূৰ্ছনা।
তাজা ফুল পায়ের কাছে নিক্ষিপ্ত হতেই দ্রুত পা পিছিয়ে নিলেন আইউবী। ডানে নাজি আর বাঁয়ে নাজির সহকারী। আইউবীকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান
জানালো তারা।
মোলায়েম ফুল-পাপড়ি মাড়াতে আসেনি সালাহুদ্দীন। ঠোঁটে রহস্যময় হাসির আভা ছড়িয়ে দিয়ে বললেন আইউবী। এমন নির্মল রহস্যময় হাসি আর দেখেননি কখনো নাজি।
আমরা জনাবের চলার পথে আসমানের তারা এনেও বিছিয়ে দিতে পারি মাননীয় গভর্নর! বললেন নাজি।
আমার যাত্রা পথে শুধু একটা জিনিস বিছানো থাকলে তা আমাকে সন্তুষ্ট করবে। বললেন আইউবী।
আদেশ করুন হুজুর কেবলা!–গদগদ চিত্তে বললো নাজির সহকারী কোন্ সে জিনিস, যা আপনার পায়ের তলায় ছড়িয়ে দিলে আপনাকে আনন্দ দেয়?
ক্রুসেডারদের লাশ। ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সুরে মুচকি হেসে বললেন আইউবী। নিমিষেই তার চেহারা কঠিন হয়ে গেলো। চোখ থেকে ঠিকরে বেরুতে থাকলো অগ্নিদৃষ্টি। ভসনামাখা অনুচ্চ আওয়াজে বললেন
মুসলমানদের জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয় জেনারেল।
মুহূর্তের মধ্যে পার হয়ে গেলো অফিসারের মুখমণ্ডল।
আইউবী বললেন আপনারা কি জানেন না, খৃষ্টানরা মুসলিম সালতানাতকে ইঁদুরের মত কুরে কুরে টুকরো টুকরো করছে? বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে আমাদের? জানেন কি, কেন সফল হচ্ছে ওরা? যে দিন থেকে আমরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে ফুলের পাপড়ী মাড়াতে শুরু করেছি, নিজেদের যুবতী কন্যাদের নগ্ন করে ওদের সম্ভ্রম ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছি, সেদিন থেকে ব্যর্থতা-ই হয়ে গেছে আমাদের বিধিলিপি। আমরা মাতৃত্বের মর্যাদা আর নারীর ইজ্জত রক্ষা করতে পারছি না। আপনারা জেনে রাখুন, আমার দৃষ্টি ফিলিস্তীনে নিবদ্ধ। আপনারা আমার পথে ফুল বিছিয়ে মিসরেও কি ইসলামের পতাকা ভূলুণ্ঠিত করতে চান?