খৃষ্টান রাজারা ইসলামী সালতানাতগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। মুসলিম শাসকদের মধ্যে বপণ করছে সংঘাত ও প্রতিহিংসার ধ্বংসাত্মক বীজ। এ কাজে খৃষ্টানরা এতই সাফল্য অর্জন করলো যে, কিছুসংখ্যক মুসলিম শাসক খৃষ্টান সম্রাট ফ্র্যাংককে বাৎসরিক ট্যাক্স দিতে শুরু করলেন। পরস্পর প্রতিহিংসাপরায়ণ মুসলিম শাসকদের ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলোতে গোপন সন্ত্রাস ও হামলা চালিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত করে নিরাপত্তা চাঁদা আদায় করছিলো খৃষ্টান রাজারা। প্রজাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেও ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করতে প্রজাদের রক্ত শুষে ট্যাক্স আদায় করে খৃষ্টান রাজাদের বাৎসরিক সেলামী আদায় করছিলো মুসলিম শাসকরা।
সামাজিক সংঘাত, আত্মকলহ ও শ্রেণীগত বিরোধে তখন মুসলমানদের একতা-সংহতি বিলীন। ধর্মীয় দলাদলি, মাযহাবী মতবিরোধে মুসলিম সম্প্রদায় শতধা বিভক্ত। হাসান ইবনে সাব্বাহ নামের এক ভণ্ড ইহুদী-পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে মিসরের সমাজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরূপে আভির্ভূত হয়। গোপনে গড়ে তোলে নিজস্ব গোয়েন্দা, সেনা ও সুইসাইড বাহিনী। এরা জঘন্য গুপ্ত হত্যায় এই প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, হাশীশ বাহিনী রূপে সারা মিসরে এরা খ্যাত।
এই সাব্বাহ বাহিনীর সাথে সালাহুদ্দীনের পরিচয় বাগদাদে। মাদরাসা নিজামুল মুলুকে পড়াশোনাকালীন সময়ে সালাহুদ্দীন জানতে পারেন; সাব্বাহ বাহিনীর গুপ্তঘাতকেরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো নিজামিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা নিজামুল মুককে।
নিজামুল মুলক ছিলেন মুসলিম খেলাফতের একজন যশস্বী গভর্নর। সুশাসক ও গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন তিনি। মুসলমানদের সর্বাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে এবং ইহুদী-খৃষ্টানদের বিপরীতে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতেই গভর্নর নিজামুদ্দীন গড়ে তোলেন মাদরাসা নিজামিয়া। অল্পদিনের মধ্যে নিজামিয়া মাদরাসা বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং শিক্ষা-দীক্ষায় খ্যাতি লাভ করে। ওখানকার শিক্ষার্থীরা ইসলাম বিরোধীদের উপযুক্ত মোকাবেলা করার যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠে। মাদরাসা নিজামিয়ায় আবশ্যিক রাখা হয় সামরিক প্রশিক্ষণ ও সমরকলা। ।
খৃষ্টানদের কাছে এ বিষয়টি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠে তাদের অস্তিত্বের জন্যে। তাই ওরা চক্রান্ত আঁটে। ওদের যোগসাজশে নিজামুল মুলকের দেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয় সাব্বাহ বাহিনী। সাব্বাহ বাহিনীকে হাত করে খৃষ্টান চক্রান্তকারীরা হত্যা করে নিজামুল মুলককে। এ ঘটনা সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্মের প্রায় শত বছর আগের।
নিজামুল মুল্কের মৃত্যু হলেও মাদরাসা নিজামিয়া বন্ধ হয়ে যায়নি। অব্যাহত থাকে ইসলামের সৈনিক তৈরীর প্রচেষ্টা। ওখানেই জাগতিক ও ধর্মীয় বিশেষ করে যুদ্ধ-বিদ্যায় প্রশিক্ষণ নেন সালাহুদ্দীন। রাজনীতি, কূটনীতি, ভূগোল, ইতিহাস ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধ কৌশলের উপর আইউবীর গভীর আগ্রহের কারণে নুরুদ্দীন জঙ্গী ও চাচা শেরেকোই তার জন্যে স্পেশাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষা অবস্থায়ই তাকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা লাতের জন্যে। সর্বক্ষেত্রেই দেখা যেতো আইউবীর অসাধারণ যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা। অনুপম কর্মকৌশলে মুগ্ধ হয়ে জঙ্গী তাকে মিসরের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেন। এখান থেকেই আইউবীর সংগ্রামী জীবনের সূচনা।
***
সেনাপ্রধান ও গভর্নর হয়ে মিসরে পদার্পণ করলেন সালাহুদ্দীন আইউবী। রাজকীয় অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল তার সম্মানে। স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা করলো জমকালো অনুষ্ঠানের। সার্বিক আয়োজনের নেতৃত্ব দিলেন সেনা অধিনায়ক নাজি।
নাজি মিসরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান, পঞ্চাশ হাজার নিয়মিত বাহিনীর অধিনায়ক। মিসরে নাজি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি। মুকুটহীন সম্রাট। ভবিষ্যত গভর্নর হিসেবে নিজেকেই একমাত্র ফাতেমী খেলাফতের যোগ্য উত্তরসূরী মনে করেন তিনি। সালাহুদ্দীন আইউবীর নিয়োগে স্বপ্নভঙ্গ হলো তার। তবে দমে গেলেন না তিনি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে দেখেই নাজি আশ্বস্ত হলেন, এই বালক তার জন্যে মোটেও সমস্যা হবে না। নিজের দাপট যথারীতি বহাল রাখতে পারবেন তিনি।
আইউবীর আগমনে বড় বড় সেনা অফিসার ও গুরুত্বপূর্ণ আমলাদের অনেকেরই ভ্রু কুঞ্চিত হলো। অনেকেই নিজেকে ভাবছিলো মিসরের ভাবী গভর্নররূপে। তরুণ সালাহুদ্দীনকে দেখে চোখাচোখি করলো তারা। অনেকের দৃষ্টিতে ছিলো তাচ্ছিল্যের ভাব। তারা জানতো না সালাহুদ্দীন আইউবীর যোগ্যতা। শুধু জানতো, সালাহুদ্দীন শাসক পরিবারের ছেলে। তাঁকে চাচা শেরেকোহর স্থলাভিষিক্ত করে পাঠানো হয়েছে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর সাথে তার আত্মীয়তা রয়েছে।
এক প্রবীণ অফিসার টিপ্পনী কাটলো–ছেলে মানুষ আমরা তাকে গড়ে নেব।
অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন আর অফিসারদের সমাবেশে আইউবী প্রথমে কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন। নাজির কটাক্ষ চাহনি আর কর্মকর্তাদের বিদ্রূপ আইউবী উপলব্ধি করলেন কি-না বলা মুশকিল। তবে বয়স্ক, অভিজ্ঞ ও প্রবীণ কর্মকর্তাদের ভীড়ের মধ্যে নিজেকে নিতান্তই বালক মনে হচ্ছিলো তাঁর। দ্রুত নিজেকে সামলে অফিসারদের প্রতি মনোযোগী হলেন আইউবী। পিতার বয়সী জেনারেল নাজির প্রতি হাত বাড়িয়ে দিলেন মোসাফাহার জন্যে। তোষামোদে সিদ্ধহস্ত নাজি পৌত্তলিকদের মত মাথা নীচু করে কুর্নিশ করলো আইউবীকে। তারপর কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো–