ঠিক তখনই পার্শ্ব পরিবর্তন করলেন আইউবী। খঞ্জর বিদ্ধ হলো সালাহুদ্দীন আইউবীর মাথার খুলি ঘেষে মাটিতে।
এই মুহূর্তে পার্শ্ব পরিবর্তন না করলে এফোঁড়-ওফোড় হয়ে যেতো তার খুলি। সালাহুদ্দীন আইউবী বিদ্বেগে ধড়মড় করে শোয়া থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি বুঝে ফেললেন, কী ঘটছে। ইতিপূর্বে দুবার একই ধরনের আক্রমণ হয়ে গেছে তার উপর। কালবিলম্ব না করে ঘাতকের চিবুকে পূর্ণ শক্তিতে একটা ঘুষি মারলেন আইউবী। চিবুকের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার মট মট শব্দ শোনা গেলো। পিছনের দিকে ছিটকে পড়ে ভয়ানক আর্তচীৎকার দিলো ঘাতক।
এই ফাঁকে আইউবী খঞ্জর তুলে নিলেন হাতে। প্রহরীর ভয়ার্ত চীকারে দৌড়ে আরো দুই দেহরক্ষী তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলো। তাদের হাতে খোলা তরবারী। সুলতান বললেন, “ওকে গ্রেফতার করো। কিন্তু আইউবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরাও। আইউবী নিজের খঞ্জর দিয়েই দুই তরবারীর মোকাবেলা করলেন। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হয়ে গেলো ঘাতক দল।
ইত্যবসরে বাইরের দেহরক্ষী দলের সবাই ঢুকে পড়লো তাঁবুতে। লড়াই বেঁধে গেলো প্রচণ্ড। আইউবী দেখলেন, তাঁর নির্বাচিত দেহরক্ষীরা দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত। বোঝার উপায় ছিলো না, এদের মধ্যে কে। তার অনুগত আর কে শক্রর এজেন্ট। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে অবস্থা নিরীক্ষণ করলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিপক্ষের তরবারীর আঘাতে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়লো উভয় পক্ষের কয়েকজন। আর কিছুসংখ্যক মারাত্মক আহত হয়ে কাতরাতে লাগলো। আহত অবস্থায় পালিয়ে গেলো বাকিরা।
লড়াই থেমে যাওয়ার পর অনুসন্ধানে ধরা পড়লো, আইউবীর একান্ত দেহরক্ষীদের মধ্যে সাতজনই হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক সদস্য। যে ঘাতক প্রথম আঘাত হেনেছিলো, তাকে আইউবী নিজেই দেহরক্ষী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। ওই নরাধম তাঁবুতে প্রবেশ করার পর ভিতরের পরিস্থিতি পরিকল্পনার বিপরীত হয়ে গেলো। ওর আর্তচীকারে বাকিরাও তাঁবুতে প্রবেশ করলে প্রকৃত প্রহরীরাও ঘটনা আঁচ করতে পেরে দ্রুত প্রতিরোধে এগিয়ে এলো। শত্রুদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেলো। এ যাত্রায়ও বেঁচে গেলেন আইউবী।
ঘাতকের বুকে তরবারী রেখে আইউবী জিজ্ঞেস করলেন–কে তুমি? কোত্থেকে কীভাবে এখানে এসেছো? আর কে তোমাকে এ কাজে পাঠিয়েছে? সত্য স্বীকারোক্তির বিনিময়ে আইউবী ঘাতকের প্রাণ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ঘাতক বলে দিলো, সে ফেদায়ী, আমীর সালেহ-এর এক কেল্লাদার গভর্নর গোমস্তগীন এ কাজে নিযুক্ত করেছে তাকে।
সালাহুদ্দীন আইউবী মুসলিম মিল্লাতের একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। খুই কাছেও কখনোই বিস্মৃত হবার নন তিনি।
সালাহুদ্দীন আইউবীর কীর্তি-কাহিনী ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাসে সংরক্ষিত। তবে তাঁর জীবন ও কর্মের বাঁকে বাঁকে আপনজন ও স্বগোত্রীয়দের হিংসাত্মক শত্রুতা, চরিত্র হনন, চারপাশের মানুষদের দ্বারা বিছানো বহু বিস্তৃত ভয়ংকর চক্রান্তজাল, শত্রুপক্ষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আঘাত আর তাঁর মিশন ব্যর্থ করতে খৃষ্টান-ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ও সুন্দরী নারীদের পাতা ফাঁদের কথা ইতিহাসের পাতায় বিস্তারিত বিবৃত হয়নি। সেসব অজানা ইতিহাস আমি বলার ইচ্ছা রাখি।
***
১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। সালাহুদ্দীন আইউবী সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করলেন। ফাতেমী খেলাফতের কেন্দ্রীয় খলীফা তাঁকে এ পদে নিযুক্ত করে বাগদাদ থেকে প্রেরণ করেন।
মিসরের সেনাপ্রধান ও শাসকের গুরুত্বপূর্ণ পদে আইউবীর মত তরুণের নিযুক্তি স্থানীয় প্রশাসকদের দৃষ্টিতে ছিলো অনভিপ্রেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসকদের দৃষ্টিতে আইউবী হলেন যথোপযুক্ত ব্যক্তি। বয়সে তরুণ হলেও আইউবী শাসক বংশের সন্তান। বাল্যকাল থেকেই কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে রপ্ত করেছেন যুদ্ধবিদ্যা। অল্প বয়সেই যুদ্ধের ময়দানে প্রমাণ করেছেন নিজের বিরল প্রতিভা ও অসামান্য দূরদর্শিতা।
সালাহুদ্দীন আইউবীর দৃষ্টিতে দেশ শাসন বাদশাহী নয়–জনসেবা। জাতির ইজ্জত-সম্মান, সমৃদ্ধি-উন্নতি এবং সেবার মাধ্যমে নাগরিকদের সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা-ই শাসকদের দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু তিনি । ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছেন মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা-অনৈক্য, একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্যে আমীর-ওমরার মধ্যে খৃষ্টানদের সাথে ভয়ংকর বন্ধুত্ব স্থাপনের আত্মঘাতি প্রতিযোগিতা।
শাসকদের সিংহভাগ জাগতিক বিলাস-প্রমোদে মত্ত। মদ, নারী আর নাচ-গানে শাসক শ্ৰেণী আকণ্ঠ ডুবন্ত। জীবনকে জাগতিক আরাম-আয়েশের বাহারী রঙে সাজিয়ে রেখেছে কর্তারা। মিল্লাতের ঐতিহ্য, মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যত ও সম্ভাবনাকে শাসক শ্রেণী নিক্ষেপ করেছে অতল-গহ্বরে।
আমীর, উজীর, উপদেষ্টা ও বড় বড় আমলার হেরেমগুলো বিদেশী খৃষ্টান সুন্দরী তরুণীদের নৃত্য-গীতে মুখরিত। শাসকদের হেরেমগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে খৃষ্টান-ইহুদীদের প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা কিশোরীরা। শাসকদের বোধ ও চেতনা সব ওদের হাতের মুঠোয়। খৃষ্টান গোয়েন্দা মেয়েরা মুসলিম শাসকদের হেরেমে অবস্থান করে মদ-সুরা, নাচ-গান আর দেহ দিয়ে শুধু শাসকদের কজায়-ই রাখছে না–মুসলিম খেলাফতের প্রাণরস ভিতর থেকে উঁই পোকার মত খেয়ে খেয়ে অসাড় করে দিচ্ছিলো তারা।