তোমরা তো যোদ্ধা জাতির সন্তান। সৈন্য ও যুদ্ধ পরিচালনা তোমাদের ঐতিহ্যের অংশ। অবশ্য প্রত্যেক মুসলমান-ই আল্লাহর সৈনিক আর আল্লাহর সৈনিক হওয়ার পূর্বশর্ত ঈমান ও কার্যকর ভূমিকা।
তোমরা খাঁচার পাখি নিয়ে ফুর্তি করো। মদ-নারীর প্রতি যাদের এত আসক্তি, সৈনিক জীবন ও যুদ্ধ পরিচালনা তাদের জন্যে খুবই বেমানান। আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, তোমরা আমাকে সহযোগিতা করো। আমার সাথে জিহাদে শরীক হও। যদি না পারো, অন্তত আমার বিরুদ্ধাচারণ থেকে বিরত থাকো। আমি তোমাদের অপরাধের কোন প্রতিশোধ নেবো না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আমীন।
-সালাহুদ্দীন আইউবী
গভর্নর সাইফুদ্দীন গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন চক্রান্তে মেতে উঠলো। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর চিঠি পড়ে তার মধ্যে দ্বিগুণ প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো। যোগ দিলো ইহুদী হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক স্কোয়াডের সাথে। শুরু হলো নতুন চক্রান্ত। হাসান ইবনে সাব্বাহর স্কোয়াড দীর্ঘ দিন ধরে ফাতেমী খেলাফতের আস্তিনের নীচে কেউটে সাপের মতো বিরাজ করছিলো।
***
হাসান ইবনে সাব্বাহ্ একজন স্বভাব-কুচক্রী। ফাতেমী খেলাফতের শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে সে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তৎপর। শুভাকাতক্ষীর পোশাকে সর্বনাশী ষড়যন্ত্রের হোতা সে। অতি সংগোপনে ইসলামী খেলাফতকে ধ্বংস করতে গোপনে গড়ে তোলে ঘাতক বাহিনী। বিস্ময়কর যাদুময়তায় সাধারণ মানুষের কাছে সজ্জন হিসেবে আসন গেড়ে নেয় তার বাহিনী। অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীর মধ্যে। সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম দেয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস।
হাসান ইবনে সাব্বাহর গুপ্ত বাহিনীতে রয়েছে চৌকস নারী ইউনিট। ওরা যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ। প্রাঞ্জল ভাষা ও বাকপটুতায় দক্ষ তারা। তাদের সংস্পর্শে গেলে যে কোন কঠিন মনের অধিকারী আর আদর্শিক পুরুষও মোমের মত গলে যায়। চক্রান্ত বাস্তবায়নে মাদক, নেশা, আফিম, হাশীশ, নাচ-গান ও ম্যাজিকের আশ্রয় নেয় তারা। এমনকি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে হাসান বাহিনীর নারী গোয়েন্দারা নিজেদের দেহ বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দীর্ঘ কঠোর প্রশিক্ষণ-অনুশীলনের মাধ্যমে উপযুক্ত হওয়ার পর শুরু হয় তাদের মূল কাজ। হাসান বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ ইসলামী খেলাফতকে নির্মূল করতে এমন একটি ঘাতক বাহিনীর জন্ম দেয় যে, এই বাহিনীর প্রশিক্ষিত গোয়েন্দারা বেশ-ভূষা ও ভাষা বদল করে কৌশলী আচার ব্যবহার দ্বারা ফাতেমী খেলাফতের শীর্ষ ব্যক্তিদের একান্ত বডিগার্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও হাত করে নেয়। এর ফলে বড় বড় সামরিক কর্মকর্তারা গুপ্ত হত্যার শিকার হতে থাকেন। কিন্তু ঘাতকের কোন নাম-নিশানা খুঁজে পাওয়া যায় না।
অল্পদিনের মধ্যেই হাসান বাহিনীর গুপ্তদল ফেদায়ী নামে সারা মুসলিম খেলাফতে ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়। এদের প্রধান কাজ রাজনৈতিক হত্যা। এ কাজে এরা বেশী ব্যবহার করে সুন্দরী যুবতী আর মদ। শরাবে উচ্চমানের বিষ মিশিয়ে আসর গরম করার পর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে তারা। কিন্তু তাদের মদ-নারী সালাহুদ্দীন আইউবীর বেলায় অকার্যকর। অবৈধ নারী সম্ভোগ আর হারাম মদ-সুরায় আইউবীর আজন্ম ঘৃণা। সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার একমাত্র উপায় অতর্কিত আক্রমণ। কিন্তু এটা মোটেও সহজসাধ্য নয়। সুলতান সালাহুদ্দীন সবসময় থাকেন প্রহরী-পরিবেষ্টিত। তাছাড়া তিনি নিজেও খুব সতর্ক।
দু দুটি আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর সালাহুদ্দীন আইউবী ভেবেছিলেন, আমীর সালেহ ও গভর্নর সাইফুদ্দীন হয়তো তাঁর চিঠি পেয়ে তওবা করেছে। ওরা হয়তো আর তার সাথে দুশমনি করবে না। কিন্তু না, ওরা প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে আছে। নতুন করে তৈরী করলো সালাহুদ্দীনকে খতম করার সুগভীর চক্রান্তের ফাঁদ।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ক্রুসেডার ও সাইফুদ্দীনের হামলা প্রতিহত করে বিজয়োল্লাসের পরিবর্তে পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। অগ্রণী আক্রমণ করে শত্রুপক্ষের আরো তিনটি এলাকা দখল করে নিলেন তিনি। বিজিত এলাকার অন্যতম একটি হলো গাঁজা।
গাঁজার প্রশাসক জাদুল আসাদীর তাঁবুতে এক দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছেন সালাহুদ্দীন আইউবী। মাথায় তার শিরস্ত্রাণ। শিরস্ত্রাণের নীচে মোটা কাপড়ের পাগড়ী।
তাঁবুর বাইরে প্রহরারত দেহরক্ষী দল। আইউবীর দেহরক্ষীরা যেমন লড়াকু, তেমনি চৌকস।
রক্ষী দলের কমাণ্ডার কেনো যেনো প্রহরীদের রেখে একটু আড়ালে চলে গেলো। এক দেহরক্ষী সালাহুদ্দীনের তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিলো। ইসলামের অমিততেজী সিপাহসালার তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। দু চোখ তার মুদ্রিত। চিৎ, হয়ে শুয়ে আছেন সালাহুদ্দীন। প্রহরী চকিত নেত্রে খাস দেহরক্ষীদের একবার। দেখে নিলো। দেহরক্ষীদের তিন-চারজন দেখলো ওই প্রহরীর উঁকি মারার দৃশ্য। চোখাচোখি হলো পরস্পর। তারা বিষয়টি আমলে নিলো না। অন্যান্য প্রহরীদের নিয়ে গল্প-গুজবে মেতে উঠলো। বাইরের প্রহরী এই সুযোগে তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলো। কোমরে তার ধারাল খঞ্জর। বের করে এক নজর দেখে নিলো সেটা। বিড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা সালাহুদ্দীনের দিকে। ..