চৌকিদার সময় মতোই যারিনার মা ও তার বউকে নিয়ে এলো। যারিনার মাকে অন্য ঘরে বসিয়ে চৌকিদারের বউকে অফিস ঘরে বসালাম এবং যারিনা সম্পর্কে যা যা জানে সব জানাতে বললাম।
যারিনা আব্বাস ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে না- চৌকিদারের বউ বললো- আব্বাসের ঘরে আমার যাতায়াত অনেক দিনের। আব্বাসের বোনদেরকে আমার খুব ভালো লাগে, ওরা আমাকে বেশ খাতির যত্ন করে। এজন্য ওদের ঘরের কাজও করি মন প্রাণ দিয়ে। ওখানে থাকাও হয় বেশি। তাই আব্বাস ও যারিনাকে আমি ওখানে যেভাবে দেখেছি আর কারো তা দেখার কথা নয়।
ওদেরকে আমি খাটের ওপরও বসা দেখেছি কয়েকবার। যারিনা তো এমনি চুপচাপ স্বভাবের ছিলো। কিন্তু আব্বাসকে দেখলেই গোলাপের পাপড়ির মতো ফুটে উঠতো। মুখের ভাষা মধু হয়ে ঝরতো। যারিনা কয়েকবার আমাকে গোপনে- যাতে কেউ না জানে সেভাবে আব্বাসকে ওদের বাসায় পাঠাতেও বলেছে।
বিয়ের পর ওদেরকে এক সঙ্গে দেখেছো তুমি?
যারিনা তো এক মাসের মধ্যে তিন চার বার বাড়িতে এসেছে চৌকিদারের বউ বললো- এর মধ্যে দুবার ওদেরকে এক সঙ্গে দেখেছি। উভয়ের চোখে মুখে তখন স্পষ্ট হতাশার ছাপ ছিলো। একবার তো যারিনার চোখে পানিও দেখেছি।
এই মহিলার কথায় আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, যারিনার প্রেমিক তার মামত ভাই আব্বাস।
পীর সাহেবকেও আমার সন্দেহ হয়- চৌকিদারের স্ত্রী বললো- পীরের খানকায় কি হয় না হয় তা তো আপনি জানেনই। তবে পীর আমার প্রতি খুব মেহেরবান। তিনি একদিন আমাকে লোক মাধ্যমে ডাকিয়ে বললেন, যে কোন ছুতোয় যারিনার শ্বশুর বাড়ি যাও। যারিনার কানে কানে বলল, তোমার স্বামী পীর সাহেবকে দিয়ে তোমাকে তাবিজ করাতে চায়।
কিন্তু পীর সাহেব তা করতে চান না। যে তাবিজ তোমাকে পান করানো হয়েছে সেটা তাবিজ ছিলো না, সাদা কাগজ ছিলো। তাই তুমি যেকোন দিন পীর সাহেবের কাছে চলে যাও, তিনি তোমাকে এমন তাবিজ দেবেন যে, ইকবাল তোমাকে তালাক দিয়ে দেবে। আর তোমার প্রেমিকের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে……।
খোদার মেহেরবাণীতে আমার আর ওদিকে যেতে হয়নি। যারিনাই দুদিন পর ওদের বাড়িতে বেড়াতে এলো। সুযোগ বুঝে ওকে আমি পীরের পয়গাম দিলাম।
যারিনা সব শুনে বললো,
পীর সাহেবকে বলবে, আপনি এমনিতেই আমার প্রতি অনেক মেহেরবানী করেছেন, আপনি যদি তালাক দেওয়াতে পারেন এবং অন্যের সঙ্গে বিয়েও পরানোর শক্তি রাখেন তাহলে আমাকে ছাড়াই আপনি একাজ করতে পারবেন। যদি আপনি এটা সত্যিই করে দিতে পারেন তাহলে আপনি যা বলবেন এর চেয়ে বেশি নজরানা পাঠিয়ে দেবো আপনার পদ মোবারকে।
আমি পীর সাহেবকে যারিনার জবাব শুনিয়ে দিলাম- চৌকিদারের বউ বলে গেলো। তিনি বললেন, ওকে বলো গিয়ে ওকে ছাড়া এই তদবির সম্ভব নয়। পরদিন সকালে যারিনাকে পীরের দ্বিতীয় পয়গাম শুনিয়ে দিলাম।
আরে আমি যদি এ ধরনের মেয়ে হতাম তাহলে ইকবালের চেয়ে সুপুরুষ আর কে আছে? অথচ ইকবালকেও আমি জবাব দিয়ে দিয়েছি। আমি আর কারো কাছে যেতে পারবো না। এত বোকা নই আমি।
এর কিছু দিন পরই যারিনা লাপাত্তা হয়ে গেলো।
পীর যারিনার কথা শুনে কি বললো?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
পীর সাহেব মাথা দুলিয়ে বলেছিলেন, এসে যাবে।
***
চৌকিদারের স্ত্রীকে ওয়েটিং রোমে পাঠিয়ে দিলাম। একটু একাকি ভাবতে বসলাম। আমার সামনে এখন দুজন মানুষ, পীর ও আব্বাস। আব্বাসের ব্যপারে আমি পরিষ্কার।
সে যারিনাকে তার ঘরে রাখতে পারবে না। আমি চৌকিদারকে ডেকে আব্বাসের ওপর সবসময় নজর রাখতে বললাম। সে যে দিকেই যায় তার যেন পিছু নেয়। গভীর রাতেও যদি আমাকে জানানোর মতো কোন কিছু ঘটে তাহলে যেন আমাকে এসে জাগিয়ে তোলে।
ওর বউকে আবার ডাকলাম ভেতরে। বললাম, তুমি আব্বাসের ঘরের ভেতর নজর রাখবে। আর পীরের কাছেও যেন যাতায়াত অব্যহত রাখে। আর চোখ কান এমনকি নাকের ঘ্রাণ শক্তিও যেন কাজে লাগিয়ে দেখে, ওখানে যারিনার গন্ধ পাওয়া যায় কিনা।
কোন এক দৈব ইশারায় পীরের ওপরই কেন জানি আমার সন্দেহ বাড়ছিলো। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পীরের যে প্রভাব ছিলো সেটা জাদুর চেয়েও তীব্র ছিলো।
এজন্য পীরের আস্তানায় প্রমাণ ছাড়া হানা দেয়া সহজ কাজ ছিলো না।
ঝুলিতে সাক্ষ্য প্রমাণ না নিয়ে পীরের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব ছিলো না। এজন্য আব্বাসের বউ ছাড়াও কয়েকজন গুপ্তচর পীরের আস্তানায় লাগিয়ে দিলাম। আব্বাসের গতিবিধির ওপর চোখ রাখার জন্যও গুপ্তচর নিযুক্ত করলাম।
যারিনার মা একা আসেননি। সঙ্গে তার স্বামীও ছিলো। মা কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে ঢোকেন। চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করেন।
আমার মেয়ের কোন খবর পেলেন ইনস্পেক্টর সাব?
আগে বসুন মা জী!- আমি সান্তনার সুর ফুটিয়ে বললাম- আল্লাহ বড় সাহায্যকারী। কিন্তু আপনি সব ব্যপার খুলে বললে আপনার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পারবো…….
আমাকে শুধু এতটুকু বলুন, ও কাকে পছন্দ করতা? সে যখন আপনাকে বলেছিলো আমাকে বিয়ে করাবেন না, তারপর এও বলেছিলো, ইকবালের সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেবেন না। তখন তো নিশ্চয় আপনি বুঝেছিলেন, ও নিজ পছন্দে বিয়ে করতে চায়।
যারিনার মার ঠোঁট দুটো ফাঁক হলো মাত্র। কিছু বলতে পারলেন না। আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। তারপর তার মাথাটি এমনভাবে নিচু করলো যেন অচেতন হয়ে ঢলে পড়ছে। সম্মান ও অভিজাত্যবোধ তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। তার মেয়ে অন্য কাউকে পছন্দ করতো এ কথটা বের করতে তার কণ্ঠ চিড়ে যাচ্ছে।