আব্দুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন এবং এটা বলে কামরায় পায়চারী করতে লাগলেন, টলয়টার খবর কী? যারিয়াব! তুমি যেতে পারো। উৎসব হবে না। সবাইকে বলে দাও।
টলয়টার খবর মোটেও আশাপ্রদ নয়। কামার হাশিম ওখানে বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজ করাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসী দল দিয়ে। ওদের মাধ্যমেই গড়ে তুলছে বিদ্রোহী দল। নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগন্থগুলোতে হাশিমের ব্যাপারে লেখা হয়েছে,
হাশিমের পেশায় কামার হলেও টলয়টায় হাজারো বিদ্রোহীর এমন নেতা বনে যায় যে, তার ইঙ্গিতে খ্রিষ্টানরা জান কুরবান করতো। তার মুখে ছিলো মধুর বর্ষণ। দুকথাতেই মানুষকে তার ভক্ত করে তুলতো। সে ইউগেলিসের ডান হাত বনে গেলো।
হাশিম কামারের সন্ত্রাসী দলের পান্ডারা মুসলিম সেনা ইউনিট যারা রাতে বিভিন্ন গ্রাম ও উপশহরে টহল দিয়ে থাকে তাদের ওপর প্রায়ই নৈশ হামলা চালায় এবং দুএকজনকে আহত করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
দিন নি এ সন্ত্রাসীদের দলীয় সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এর কৃতিত্ব সব হাশিমের। সেই যুবকদের সংগঠিথ করছে। এসব যুবকদের অধিকাংশের বাপ-দাদারা ত্রিশ বছর আগের এক বিদ্রোহে জড়িত থাকায় বিদ্রোহ দমনকারীদের হাতে মারা পড়ে।
হাশিম কামার এসব যুবকের মনে সেসব স্মৃতি তাজা করে দিয়ে তাদের পিতৃপুরুষদের প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলে তার দলে ভেড়াচ্ছে।
টলয়টায় একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে, টলয়টায় করবস্থানে রাতে এক দরবেশকে দেখা যায়। সে সশব্দে ঘোষণা দেয়ার মতো করে বলতে থাকে,
ঈসা মাসীহের পূজারীরা! জেগে উঠো তোমরা। তোমাদের ওপর কেয়ামত নেমে আসছে। টলয়টা রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে।
লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, এটা কোন মৃত পাদ্রীর আত্মা। নতুন এক পয়গাম দিচ্ছে। গির্জায় গির্জায় এ ব্যাপারে আলোচনা চলতে লাগলো। গির্জার পাদ্রীরা বলতে লাগলো, এ ধরনের আত্মাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এধরনের আত্মা নাজাতের নতুন পথ দেখিয়ে থাকে।
কয়েকদিনে পর খবর ছড়িয়ে পড়লো। কবরস্থানে রাতের বেলায় প্রদীপের আলো বাতাসে উড়ে যায় এবং আওয়াজ আসে,
তোমাদের নিদ্রা-বিশ্রাম বিসর্জন দাও। জেগে উঠো। সবাইকে জাগিয়ে তোলো। তোমাদের দিকে সে কেয়ামত ধেয়ে আসছে, সেটাকে প্রতিরোধ করো।
একটু থেমে আবার আওয়াজ উঠে,
না হলে ধ্বংস অনিবার্য।
মৃত্যুর নদী এগিয়ে আসছে।
খ্রিষ্টানরা প্রেতাত্মা এবং মৃত মানুষের ভূত-প্রেত হয়ে যাওয়ার ওপর বিশ্বাস রাখে। ওদের বিশ্বাস, মন্দ আত্মা ক্ষতি করে এবং পূণ্য আত্মা ভালো কোন কথা বা মুক্তির ইঙ্গিত দিয়ে যায়।
এজন্য খ্রিষ্টানরা দলে দলে রাতে কবরস্থানে যেতে লাগলো। কবরস্থানে বেশ বড়। এর কোথাও সমতল কোথায় অসমতল জায়গা রয়েছে। আবার টিলা টক্করও রয়েছে কিছু।
লোকেরা কবরস্থানের বাইরে দাঁড়িয়ে মৃত আত্মার কথা শুনে এবং এক ধরনের আলো বাতাসে উড়তে দেখে।
এক রাতে কবরস্থানের বাইরে অনেক লোকের সমাবেশ হলো। সেদিন গির্জাগুলো থেকে এ ঘোষণা মুখে মুখে খ্রিষ্টানদের কাছে পৌঁছে গেলো যে, আজ রাতে মৃত আত্মা নিশ্চয় কোন পয়গাম নিয়ে আসবে।
তাই লোকরা সে রাতে দলে দলে কবরস্থানে গিয়ে জমা হতে লাগলো।
টলয়টার ফৌজ তাদের ব্যারেকে তখন ঘুমুচ্ছে। আর গভর্ণর ইবনে ওসীম কোন এক সেনা ব্যারেক পরিদর্শনে সীমান্ত অঞ্চলে সফর করছেন।
খ্রিষ্টানদের এই ভেল্কি বাজি কোন সরকারি কর্মখর্তা দেখতে পেলো না।
পুরো কবরস্থান গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে। লোকদের মধ্যে কবরস্থানের অজানা ভয় ছেয়ে আছে। পুরো পরিবেশটাই রহস্যময় এবং গা ছমছম করা।
লোকজন নীরব-নিস্তব্ধ। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
আচমকা কবরস্থান থেকে এক পুরুষালী ফ্যাসফ্যাসে গলা শোনা গেলো। সমবেত খ্রিস্টানরা ভয়ে কেঁপে উঠলো।
নিজেদের প্রিয় ধর্মকে নিজেদের বুকে জাগ্রত করে নাও। কল্পনায় কুমারী মরিয়মের কথা চিন্তা করো এবং এদিকে দেখো।
সমবেত লোকেরা এক ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করলো। যেটা এক ছন্দায়িত গুঞ্জরণের মতো শোনাচ্ছে এবং গা ছমছম পরিবেশকে আরো গাঢ়তর করে তুলছে।
হঠাৎ কবরস্থানের মাঝখান থেকে একটা আগুনের শিখা ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। যেন কেউ আগুন জ্বালিয়েছে ওখানে। এর সঙ্গে সঙ্গে সাদাটে ধোঁয়ার এক বাদল সেখানটায় ছেয়ে গেলো। যেটা ক্রমেই ঘনীভূত হতে হতে আবার হালকা হতে শুরু করলো। আর এর সাথে সাথে এক মেয়ের দৈহিক আকৃতি স্পষ্ট হতে লাগলো। আগুনের শিখা এসময় আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
সমবেত ক্রুশের পূজারীরা দেখলো, যেখানে ধোয়ার মেঘ দেখা গিয়েছিলো ওখানে স্বর্গীয় রূপ নিয়ে এক যৌবনবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় রুমাল বাঁধা। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো।
লোকেরা যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। অনেকেই হাঁটু মুড়ে বসে হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে রইলো। আত্মা বলে উঠলো,
পাপের প্রায়শ্চিত্ত আদায় করো। সবাই উঠো এবং খোদার পুত্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করো। আর যদি তা না করো তাহলে আমি খোদার গজব হয়ে তোমাদেরকে ছারখার করে দেবো।
এই কুমারী মরিয়মের আত্মা ছিলো ফ্লোরা।
একটু পরই আগুন নিভে গেলো। কবরস্থান অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।
পরদিন এঘটনাই টয়টায় বিদ্রোহের আগুন হয়ে দেখা দিলো।