তাদের ধর্ম এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ভায়াবহ ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে ইউগেলিস ও ফ্লোরা কথা বলতে লাগলো। এক পর্যায়ে দুজনে দুজনের ব্যক্তিগত কথাবার্তাও জিজ্ঞেস করলো।
ফ্লোরা ইউগেলিসের কাছে জানতে চাইলো, সে কি তার মিশনের কারণে বিয়ে করেনি, না তার পছন্দের মেয়ে এখনো সে পায়নি।
আমি একজন রক্ত-মাংসের মানুষই ফ্লোরা! ইউগেলিস বললো, কোন মানুষ এটা দাবী করতে পারবে না যে, সে তার কামনা বাসনার উর্ধ্বের উঠে গেছে। তবে আমি এমন দাবী করে থাকি। কিন্তু আমার এই দাবি সত্য নয়। তুমি সদ্য যুবতী মেয়ে ফ্লোরা! এখনই হয়তো তুমি আমার সব কথা বুঝবে না। সবাই নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু কামনা-বাসনা, রিপুর তাড়না খুব কম মানুষই বিসর্জন দিতে পারে।….
ধর্মের ব্যাপারে আমি এমন উন্মাদ আর আপোষহীন যে, আমার কাছে দুনিয়ার আর কিছু ভালো লাগে না। তিন সুন্দরী মেয়ে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু ওদের প্রস্তাব আমার কাছে মনে হয়েছে এক বন্দি জীবনের জন্য নিজের গলায় শিকল পরে নেয়া। একবার যদি এই শিকল উঠে তাহলে হয়তো আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো না।
ফ্লোরা ইউগেলিসের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলো যার মধ্যে যেমন আস্থার প্রতিফলন আছে তেমন আছে সহানুভূতি এবং এমন উপলব্ধির ছায়াও ফ্লোরার চোখে মুখে দেখা গেলো যেন সে ইউগেলিসের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে।
যেন ওদের দেহ মন কোথাও গিয়ে একাকার হয়ে যাবে।
আমি আমার ভেতরের কান্না শোনাচ্ছি না ফ্লোরা! ইউগেলিস বললো, বাস্তব কথা হলো, বড় কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য সফল করতে হলে এমন এমন ত্যাগ স্বীকার করতে হয় যেটা দেখলে তুমি বলবে কোন মানুষ এমন ত্যাগ দিতে পারে না। আগুনের অঙ্গার গলায় পুরতে হয়। বিষ পান করতে হয়। এবং নিজের হাতে নিজের গলা টিপে দিতে হয়।…।
আমি এই সবক পেয়েছি মুসলমানদের থেকে এবং শিক্ষাও অর্জন করেছি তাদের থেকে। আমি খুব ভালো করে কুরআন পড়েছি এবং ওদের বিখ্যাত কয়েকটা তাফসীরও পড়েছি। এসব পড়ে আমি এতই ইসলামের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ি যে, মুসলমান হয়ে যাওয়ার ফায়সালা করে বসি। কিন্তু একটা বিষয় আমার মধ্যে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয় যে, যে আমাদের ইঞ্জীল কেন ওদের কুরআনের মতো এমন পূর্ণাঙ্গ আর এতে মনোমুগ্ধকর নয়?
আসলে খোদার ইচ্ছা আমার কাছ থেকে অন্য কোন কাজ নেয়া। তাই আমি ইসলামের বিরুদ্ধে চলে যাই…। তোমাকে আমি একটা কথা বলছি, মনোযোগ দিয়ে শোনো। যতদিন মুসলমানরা নিজেকের ধর্মের প্রতি পূর্ণ অনুগত ছিলো ততদিন তাদের ধর্ম চার দিকে বিজয়-কেতন উড়িয়েছে। ওরা যে দেশেই গিয়েছে ওদের চরিত্র মাধুরী দেখে সেখানকার লোকেরা তাদের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাদের ধর্ম বুকে টেনে নিয়েছে।…..
কিন্তু কোন এক সময় সুযোগ বুঝে আমাদের পূর্বপুরুষরা মুসলমানদের মধ্যে নারীর রূপ-সৌন্দর্য, সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ খুব কৌশলে ঢুকিয়ে দেয়। তখন থেকেই তাদের পতন শুরু হয়ে যায়। উন্দলুসের এখনো ইসলাম শুধু এ কারণে আছে যে, ইসলামের জন্য নিজের প্রাণ ও সবধরণের কামনা-বাসনা বিসর্জন দেয়ার মতো লোক এখনো এখানে আছে।
যেমন কর্ডোভার ফৌজের সালাররা এবং আরব থেকে আসা কিছু নারী যারা নিজেদের ধর্মের জন্য নিজের জান বাজি রেখে বসে আছে।….
আর না হয়, সুলতান, আমীর উমারা এবং শাহী খান্দানের লোকেরা তো সেই কবেই ইসলামের শিকড় ছিবড়ে করে ফেলেছে। আমি ওদের থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে, জান ও জযবা বিসর্জন দাও তো সফলতা তোমার পায়ে এসে চুমু খাবে।……
আমার কামনা-বাসনা ছিলো বড়ই তৃষ্ণার্ত। কারণ, শৈশবেই আমার মা বাবা মারা যায়। ভালোবাসার রূপ রঙ কী এর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই ফ্লোরা! আমি যখন কোথাও ক্লান্ত হয়ে একাকি থাকি তখন এক আশ্চর্য ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করি।……
এটা সম্ভবত! আমার আত্মার তৃষ্ণা। তখন আমি এক ধর্মীয় পন্ডিত ও নেতা থেকে সাধারণ মানুষের স্তরে নেমে আসি এবং অস্থির হয়ে যাই যে, আমার এমন কোন জিনিসের প্রয়োজন যা আমি জানি না।….
কখনো শুয়ে শুয়ে আমার অজান্তেই হাত দুটো আমার বিছানার চার দিকে ঘুরে বেড়ায়। নিজের সঙ্গে ঝগড়া করি। নিজেকে গাল-মন্দ করি এবং এক সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। তখন ভাবতে থাকি, ইসলামের শিকড় কি করে উপড়ে ফেলা যায়। উঁহু ফ্লোরা! তোমার তো মনে হচ্ছে ঘুম আসছে। উঠো। তোমার কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।
ফ্লোরা কোন কথা না বলে উঠে পড়লো।
ইউগেলিস তার কামরায় শুয়ে পড়লো। কিন্তু ফ্লোরার ঘুম এলো না। তার মাথায় ক্ষণে ক্ষণে ইউগেলিসের কথাগুলো গুন গুন করতে লাগলো। নিজেই স্বগোতিক্তের মতো বলে উঠলো,
আহা, লোকটি বড়ই তৃষ্ণার্ত। অথচ তৃষ্ণা মেটানোর সহজ সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগচ্ছে না। কত বড় ত্যাগ স্বীকার করছে। আহা প্রেম-ভালোবাসা কি তা জানে না। কত প্রেম নিবেদন ফিরিয়ে দিয়েছে।
ফ্লোরা উঠে বসলো। অন্ধকারে ঘুরতে লাগলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। মনে হলো তার দম বন্ধ হয়ে আসবে। এমন অনুভূতির সমুমখীন সে কখনো হয়নি।
সে ইউগেলিসের কামরার দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেলো। চৌকাঠ পেরিয়ে পা ঘেষটাতে ঘেষটাতে সে সেদিকে এগিয়ে গেলো যেদিকে ইউগেলিসের খাট রয়েছে।