এই দুজন যদি সবসময় তার হাতে থাকে তাহলে তো আমরা খুব তাড়াতাড়ি সফল হবো। ফ্লোরা বললো।
না, জনসন তাকে বাঁধা দিয়ে বললো, এ দুজনের ওপর আমাদের পুরোপুরি বিশ্বাস নেই। কারণ, যত কিছুই হোক ওরা মুসলমান! তাছাড়া একজন গায়ক আর আরেকজন সুলতানা কেবল একজন রক্ষিতা। এরা আসলে দরবারী চাটুকার। চরম স্বার্থপর। ওদের সাথে আমরা খুব সাবধানে কথা বলি।
আমি তোমাকে বলছিলাম, সুলতানার রূপ যৌবন অতুলনীয়। এমন সুন্দরী এক মেয়ে তারই জায়গীরে ইউগেলিস একলা রাত কাটিয়েছে; কিন্তু সুলতানা এই পাথরকে মোমে পরিণত করতে পারেনি।
ফ্লোরার রূপও অতুলনীয়। কিন্তু একজন রূপবর্তী মেয়ে যেমন একজন রূপদর্শন পুরুষের স্বপ্ন বুকে নিয়ে রাত দিন কাটিয়ে দেয়, ফ্লোরার মধ্যে সেই স্বাভাবিক বোধটাই নেই। এ ধরণের মেয়েরা তো কোন প্রেম কাহিনীর নায়িকা বা কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়।
এক মুসলিম ঐতিহাসিক ইবরাতনামায়ে উন্দলুস নামক গ্রন্থে লিখেছেন,
ফ্লোরা নিজেকে নিজে নারীই মনে করতো না। খ্রিষ্টবাদ তার ওপর এক উন্মাদনা ও উম্মত্ততা হয়ে সাওয়ার হয়। কখনো মনে হতে কোন অদৃশ্য কিছু তাকে এক ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
পরদিন কর্ডোভায় এক হুলুস্থুল পড়ে গেলো। কয়েদী মেয়েটি নজরবন্দী থেকে পালিয়েছে। তার কামরায় এক প্রহরী মহিলার লাশ পাওয়া গেছে। বাড়ির ছাদের পিলারের সঙ্গে ঝুলন্ত একটি লম্বা রশি পাওয়া গেছে। সেটা লাগায়ো রাস্তা পর্যন্ত নেমে গিয়েছে।
বাকি দুই প্রহরী মহিলাকে পুলিশী হেফাজতে নিয়ে নেয়া হলো। তাদের থেকে জানা গেলো, যে ধর্মীয় পন্ডিত ফ্লোরাকে দীক্ষা দিতে যেতেন তিনিই রশি নিয়ে আসেন। পন্ডিতকে গ্রেফতার করা হলো।
পন্ডিত তখনই বুঝতে পারলেন, ফ্লোরা যেমন সুন্দরী এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চতুর। সে আসলে প্রেম-ভালোবাসার জাদু চালিয়ে তাকে বোকা বানিয়ে পালানোর পথ তৈরি করে নিয়েছে। বেচারার অনুতাপের আর শেষ রইলো না। অপরাধের উপলব্ধি তাকে এমন আঘাত করলো যে, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন।
তাকে কাঠগড়ায় যখন দাঁড় করানো হলো তখন দেখা গেলো, তিনি কখনো নিজের কাপড় খামচে ছিঁড়ছেন, কখনো নিজের হাত কামড়াচ্ছেন। কখনো প্রহরীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন। আদালত তাকে পাগল সাব্যস্ত করলো এবং মুক্তি দিয়ে দিলো।
আর যে মেয়েকে সুপথে আনতে গিয়ে সরকারের একজন মহিলা প্রহরী হারাতে হয়েছে এবং এক ধর্মীয় পন্ডিতের পাগল হতে হয়েছে সে মেয়ের পেছনে ছুটে আর লাভ নেই। সে নিজেই তার ধ্বংসের পথ বেছে নিয়েছে। ফ্লোর ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা সমস্ত মামলা আদালত খারিজ করে দিলো।
কয়েক দিন পর উস্কখুস্ক চুলের এক পাগল দেখা গেলো কর্ডোভা শহরে। সে কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে, সূর্যের দিকে আঙ্গুল তাক করে বিড় বিড় করে কি যেন বলে। এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে হতাশা প্রকাশ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক পথচারী তার আশে-পাশে জমা হয়ে যায়।
পাগলের কান্ড কারখানা দেখে তারা কৌতুক বোধ করে। কিন্তু পাগল ভিঢ় এড়িয়ে এক গলিতে ঢুকে পড়ে। তিন চারটা গলির মোড় ঘুরে ঘুর এক গলির একটি বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।
তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নেয় কোন মানুষ আছে কিনা। না, গলিতে কেউ নেই। কোন শব্দ না করে দরজার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং নিজেই ভেতর থেকে দরজার শিকাল চড়িয়ে দেয়।
ফ্লোরা এ বাড়িতেই থাকে।
বাড়ির মালিক জনসন দৌড়ে আসে এবং পাগলকে ব্যকুল হয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, ইউগেলিস! আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
ইউগেলিসও তাকে আলিঙ্গন করে।
ইউগেলিস নিজের ছদ্মবেশ পাল্টালো। গোসল করে ধূলোবালি পরিস্কার করলো। জনসন তাকে ফ্লোরা ব্যাপারে জানালো। আদালতে বিচারকের সামনে ইসলামের বিরুদ্ধে সে যে নোংরা কটুক্তি করেছে সেটাও জনসন ইউগেলিসকে শোনালো।
এখনই আমাকে ওর সামনে নিয়ে চলো। এ তো কুমারী মরিয়মের পবিত্র আত্মা মনে হচ্ছে। ইউগেলিস ব্যকুল কণ্ঠে বললো।
ফ্লোরা ও ইউগেলিস দুজন যখন মুখোমুখি হলো দুজনই দুজনের মনে ধাক্কার মতো খেলো। কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফ্লোরা ধীরে ধীর ইউগেলিসের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাটু চুমু খেতে ঝুলতে গেলো। ইউগেলিস তার অজান্তেই ফ্লোরাকে উঠিয়ে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো।
তুমি এক নিষ্পাপ মেয়ে। ইউগেলিস তাকে পৃথক করে তার মুখটি নিজের দুহাতের করোটিতে রেখে বললো।
মরিয়মও এমনই নিষ্পাপ ছিলেন। হযরত ঈসা (আ.)ও ছিলেন খুব সাধা সিধা। কিন্তু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে ছিলেন। তুমিও ক্রুশ বিদ্ধ হবে। শূলিতে ঝুলানো হবে তোমাকে।
আমি এ জন্যই জন্মগ্রহণ করেছি। ফ্লোরা আবেগী গলায় বললো, আমার কুমারিত্বকে অটুট রেখেই আমি শূলিতে ঝুলবো। আপনি কি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে, আমার প্রাণ আমার ধর্মের জন্য কোন কাজে লাগাবে? আরব থেকে আসা ঐ দুশমনদের শাহরগে কি আমার রক্ত মরণ বিষ হয়ে ঝড় তুলতে পারবে?
ইচ্ছা, দৃঢ়তা, সংকল্প এবং একচ্ছত্র আবেগ থাকলে কোন কাজটা অসম্ভব? ইউগেলিস ওকে তার কাছে বসাতে বসাতে বললো, তুমি বিচারকের সামনে ইসলাম ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গালমন্দ করে আমার সামনে নতুন এক পথ খুলে দিয়েছে। আমি আমার আন্দোলনকে এপথেই চালাব। আমি এমন জানবার্য তৈরি করবো যারা জন সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইসলামকে। গালমন্দ করবে। ওদেরকে পাকড়াও করা হবে। শাস্তি দেয়া হবে। সেদিনই এভাবে বিভিন্ন জায়গায় আরো কয়েজন একই কাজ করবে।