যাও সুলতানা! তোমাকে আমি এবারের মতো মাফ করে দিলাম।
মুদ্দাসসিরা দুধের পেয়ালাটি হাতে নিয়ে ছন্দোবদ্ধ পায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর এই পেয়ালা রাতের অন্ধকারে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।
আর সুলতানার অবস্থা সেই নাগিনীর মতো হয়ে গেলো, যার বিষ কালের ঝড়ে উড়ে গেছে।
***
ফ্লোরা সেই পৃথক বাড়িতেই নজরবন্দি হয়ে আছে। ধর্মীয় পন্ডিত তাকে নিয়মিতই তালীম দিয়ে যাচ্ছেন। ফ্লোরার চাপাচাপিতে পন্ডিতকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু সময় বাড়িয়ে সেখানে থাকতে হচ্ছে। ফ্লোরা তার সাথে এখন অসংকোচ ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছে। পন্ডিতের আসতে সামান্য বিলম্ব হলেই ফ্লোরা অনুযোগের সুরে বলে,
আপনার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে যায়। মাথা ধরে যায়। অন্য কেউ যদি আমাকে নিয়ে এমন অবহেলা করতো আমি তার কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনতাম না। কিন্তু আপনি যতই অবহেলা করুন আমাকে; আপনাকে দেখার পর আমার সব দুঃখ কষ্ট হতাশা শেষ হয়ে যায়।
ধর্মীয় পন্ডিত এখন দীক্ষায় দেয়ার চেয়ে ফ্লোরার প্রত্রিই বেশি মনোযোগী। ফ্লোরার সঙ্গে তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন ওরা পরস্পর গভীর বন্ধু। গল্প গুজব করার পর তাকে সবক দেন। এতদিন ফ্লোরা তার সামনে বসতো। তারপর তার সাথে এসে বসতে শুরু করে।
একদিন বইয়ের ওপর ফ্লোরা এমনভাবে ঝুঁকে পড়ে যে, ফ্লোরার চুল পন্ডিতের গালে স্পর্শ করে। ফ্লোরা একটি হাত পন্ডিতের কাঁধের ওপর রাখে।
পন্ডিতও যেন তার অনিচ্ছায় একটি হাত ফ্লোরার কোমরে নিয়ে রাখে। ফ্লোরা তার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে ফিক করে হেসে ফেলে যেন পন্ডিত তার এক গোপন ইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছেন।
আপনি আমাকে বলেন, মনে যেন খোদার ভালোবাসা সৃষ্টি করি। ফ্লোরা তার ধর্মীয় পন্ডিতকে বললো, কিন্তু আমার মন তো আপনার ভালোবাসায় ব্যকুল হয়ে যায়। এটা কি পাপ?
না।
ফ্লোরা নিজের গাল পন্ডিতের গালের সঙ্গে লাগালো। পন্ডিত যেন তার জীবনের সব শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে গেলেন। কিন্তু ফ্লোরা সঙ্গে সঙ্গেই একটু দূরে সরে গেলো। সে তো পন্ডিতের ভেতর আগুনের সলতে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
পরের কয়েক দিন ফ্লোরা পন্ডিতের সাথে প্রেমের এমন উম্মত্ত অভিনয় করলো যে, পন্ডিতের মন-মগজে ফ্লোরা চরম এক নেশা হয়ে সওয়ার হলো। একদিন ফ্লোরা ধর্মীয় পন্ডিতকে বললো,
আপনি চলে যাওয়ার পর সারা দিন এমন একা আর নিঃস্ব লাগে যে, ইচ্ছা করে মরে যাই। যদি মোটা একটা রশি পেতাম তাহলে ঐ উঠোনের গাছগুলোতে রশি বেঁধে দোলনা বানিয়ে নিতাম। ছোটকাল থেকেই দোলনা খেলা আমার দারূণ পছন্দ। দোলনা পেলে আমি খাওয়া দাওয়াও ভুলে যাই। আমার জন্য বড় সড় একটা রশি নিয়ে আসবেন?
অবশ্যই। তুমি বললে তোমার জন্য কূহে নূর থেকেও তোমার চাহিদা পূরণ করে দেবো।
পরদিন ধর্মীয় পন্ডিত বেশ শক্ত আর অনেক লম্বা একটা রশি নিয়ে এলেন। প্রহরী মহিলারা একটু আপত্তি করলো যে, এই মেয়ে তো এই রশির সাহায্যে পালিয়ে যেতে পারে। পন্ডিত তাদেরকে বললেন, তোমরা নিজের হাতে বাড়ির আঙ্গিনায় কোন একটা গাছে রশি বেঁধে দোলনা বানিয়ে দাও। তাহলে তো আর সে ওখান থেকে রশি খুলে নিতে পারবেন।
প্রহরী মহিলাদের আর আপত্তি রইলো না। ওরা তাই করলো। আর ফ্লোরার প্রতি ওরা বেশ সন্তুষ্ট। মেয়েটি বেশ সাধা-সিধা এবং এখন পর্যন্ত এমন কোন আচরণ করেনি যাতে করে ওকে সন্দেহ করা যায়।
ফ্লোরা সে রাতেই সেই দোলনার রশির সাহায্যে তার কয়েদখানা থেকে পালালো। এর আগে প্রহরী এক মহিলাকে গলাটিপে অজ্ঞান করে নেয়।
.
ফ্লোরা পালিয়ে কোথায় যাবে এটা তার জানা ছিলো। কর্ডোভায় এক খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীর বাড়ি আছে। এ বাড়িতে প্রায়ই খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের গোপন আড্ডা বসে। এর নাম জনসন। ফ্লোরার মা এর বাড়িতে তাকে নিয়ে অনেকবার এসেছে। ইউগেলিস ছদ্মবেশে যখন কর্ডোভায় আসে তখন এই জনসনের বাড়িতেই উঠে।
ফ্লোরা জনসনের বাড়ির দরজার কড়া নাড়লো। জনসন দরজা খুললো, এত রাতে ফ্লেরকে দেখে তো তার মুখ হা হয়ে গেলো। তার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। ফ্লোরা তাকে জানালো, সে কি করে পালিয়ে এসেছে।
কে জানে তোমাকে আবার আমার ঘরে কত দিন বন্দি হয়ে থাকতে হয়? জনসন বললো, তবে সকালে আমি আমাদের লোক দিয়ে কেন্দ্রে খবর পাঠিয়ে দেবো। ওখান থেকে এক সময় কেউ এসে তোমাকে কর্ডোভা থেকে নিয়ে যাবে।
আমার আম্মুর কী খবর?
তোমার ভাই বদর তোমার মা ও তোমার বোন বালদীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। দুই দিন আমার এখানে ছিলো। ওদেরকে অনেক দূরে এক নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কর্ডোভা থেকে তুমি বের হলেই তুমি কোথাও না কোথাও এদের দেখা পেয়ে যাবে। আমাদের গুরু ইউগেলিস দুচার দিন পর কর্ডোভা আসছেন। উনি এখানেই উঠবেন। তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে।
ইউগেলিস…. উহ … ইউগেলিস ফ্লোরা বাচ্চাদের মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠলো প্রায়। আমার আম্মু ওর ব্যাপারে কত গল্প শুনিয়েছে আমাকে। নিজের যৌবন জীবন আবেগ ভালোবাসা সব ইসলামের ধ্বংস ও খ্রিষ্টবাদের বাদশাহী প্রতিষ্ঠায় ওয়াকফ করে দিয়েছেন তিনি।
ইউগেলিস তো খুবই সুদর্শন এক যুবক। জনসন বললো, তিনি বিয়ে করবেন না বলে কসম করেছেন। ঈসা মাসীহের আসল দেওয়ানা তিনি। আমীরে আব্দুর রহমানের হেরেমের হীরা সুলতানা মালিকায়ে তরূব এবং শিল্পী যারিয়াব তোতা তার জন্য পাগল পারা।