ঘরের এই শীতল পরিবেশেও সুলতানার মুখায়ব ঘামে চিক চিক করে উঠলো। টানা টানা চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। তারপর তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। সে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে খপ করে বিষের পেয়ালা হাতে উঠিয়ে নিলো। ফুপাতে ফুপাতে বললো,
আমি আর এখন বেঁচে থাকতে চাই না।
এই বলে পেয়ালা মুখের দিকে নিয়ে গেলো। মুদ্দাসসিরা একটি হাত লম্বা করে ওর ঠোঁটের ওপর রাখলো এবং অন্য হাতে পেয়ালাটি নিয়ে নিলো।
এর অর্থ হবে আমি তোমাকে বিষ দিয়ে মেরেছি। মুদ্দাসসিরা মুচকি হেসে বললো এবং পেয়ালাটি আগের জায়গায় রেখে দিলো।
সুলতানা দিশেহারা হয়ে মুদ্দাসসিরার দুহাত জড়িয়ে ধরে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে গেলো।
তুমি যদি শাহী খান্দানের স্ত্রী হয়ে থাকো এবং আমার চেয়ে তোমার অবস্থান অনেক উঁচু হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে এর প্রমাণ দাও। সুলতানা ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গি করে বললো, জানি আমার এ পাপ ক্ষমার অযোগ্য। তবুও আমাকে ক্ষমা করে দাও। শাহে উন্দলুসকে যদি তুমি এটা বলে দাও তিনি আমাকে কি বাঁচিয়ে রাখবেন?
***
হ্যাঁ, মুদ্দাসসিরা বললো, তিনি তোমাকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখবেন। এত সহজে তোমাকে মারবেন না। তবে কয়েদখানার সে অংশে তোমতার বসবাস হবে যেখানে ভয়ংকর সব পোকা মাকড়ের বসবাস।
সুলতানা মুদ্দাসসিরার দুহাটু জড়িয়ে ধরলো। আর হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো।
আমি তোমাকে এই রসহস্যময় জীবেনর মঞ্চে বাঁচিয়ে রাখবো। মুদ্দাসসিরা বললো, আমীরে উন্দলুস তোমাকে ভালোবাসেন। আমি জানি, যা আমি বলছি আমার ধর্ম-বিবেক সেটাকে গুনাহই মনে করে।……..
কিন্তু আমার মাথা কখনো আমার ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করে না। গর্ব করেই বলতে পারি আমি। আমার চিন্তা-চেতনায় আছে প্রসারতা এবং মনে আছে গভীরতা। আমি আমার নয়; উন্দলুসের স্বার্থ নিয়ে সবসময় চিন্তা করি। উঠো। খাটে উঠে বসো।
সুলতানা উঠলো এবং জানোয়ারের মতো খাটের ওপর গিয়ে বসলো। মুদ্দাসসিরা তার বুকে টোকা দিয়ে বললো,
শোন সুলতানা! মনোযগো দিয়ে শোনা! এই পেয়ালা ভেঙ্গে যাবে। এই বিষ মিশ্রিত দুধ মাটি খেয়ে ফেলবে। তারপর সময় তার আপন গতিতে চলতে থাকবে। বছরের পর বছর কেটে যাবে। কিন্তু তোমার এই অপরাধ না কোন মাটি ঢেকে নেবে। আজকের সময় কখনো বিস্মৃতিতে চলে যাবে। বিকের এই পেয়ালা তোমারা ঠোঁটের ওপর ঝুলতে থাকবে। যেখানেই তুমি একটু অসাবধান হবে সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য এক হাত বিবেকর সেই পেয়ালা তোমার গলায় উপুড় করে ঢেলে দেবে।…..।
তোমার এই অপরাধ আমি হজম করার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমার কয়েকটা শর্ত শুনে নাও। জীবনের কোন এক সময়ও যদি কোন একটা শর্তের বরখেলাপ করো তাহলে ভেবে দেখো কী ভয়ংকর পরিণাম হবে তোমার!
প্রথম কথা হলো, খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও। আমারও অতি বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ গুপ্তচর আছে। যা আমাকে সবসময় সবধরনের সংবাদ দিয়ে থাকে।
তুমি যদি স্বপ্ন দেখে থাকো, এই খ্রিষ্টানরা, ক্রুশের পূজারীর তোমাকে কোন অঙ্গ রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবে এই চিন্তা এখনই দূর করে দাও। ওরা তোমাকে ধোঁকা দেয়া ছাড়া আর কিছুই দেবে না। এই কাফেরদের যে হোতা আছে ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো। ইউগেলিস ও ইলওয়ারকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। হ্যাঁ, ওদেরকে যদি ধোকা দিতে পারো কিংবা ওদেরকে গ্রেফতার করতে পারো তাহলে এটা তোমার জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তোমার প্রতিটি শর্তই মেনে নেবো। সুলতানা হাতজোড় করে বললো, আমাকে ক্ষমা করে দাও। শাহে উন্দলুসকে কিছুই বলল না বোন!
ঠিক আছে বলবো না। ভবিষ্যতে কখনো আমীরে উন্দলুসকে বলবে না যে, তার চেহারায় ক্লান্তি রয়েছে। তাঁকে এই নয়া শরবত পান করাবে না আর। সালতানের কোন বিষয়ে এবং আমীরে সালতানাতের কোন ফায়সালায় কখনো হস্তক্ষেপ করবে না। তুমি একজন রক্ষিতা ছাড়া কিছুই নও। এটা মনে রেখে মহলে চলাফেরা করবে। নিজের ধর্মে ফিরে আসার চেষ্টা করো। যারিয়াবকে ব্যবহার করা ছেড়ে দাও।
কিন্তু মুদ্দাসসিরা! সুলতান বললো, যারিয়াব তো আমার প্রেমে দেওয়া না।
তুমিও ওর প্রেমে দেওয়ানা হয়ে যাও। মুদ্দাসসিরা বললো, তোমার সবকিছু ওর সত্বায় সমর্পন করে দাও। কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু আমীরে উন্দলুসকে মহলের কয়েদী বানাবে না কখনো সুলতানা! তোমার নজর শুধু এই আজকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমার জীবনের একমাত্র নীতি হলো, আজ ভোগ করে নাও।….
কিন্তু আমার দৃষ্টি ভবিস্যৎ পর্যন্ত প্রসারিত। আমার নয়, মুসলিম জাতির ভবিষ্যৎ এটা। আমার ইতিহাস সেই নন্দিত ইতিহাসের ওপর রচিত হচ্ছে যা মৃত্যুর পর লেখা হবে। আমি সেই ইতিহাসকে আলোকিত করতে চাই, যার আলোয় পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের পথ চিনে নিতে পারবে।
হয়তো আমার কথাগুলো তোমার উপলব্ধির উর্ধ্বে চলে যাচ্ছে। তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে জানি। কিন্তু সেটা অনবরত পাপ আর নোংরা চক্রান্তে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবুও বুঝতে চেষ্টা করো।…..
কিছু তো বুঝতে পারছি মুদ্দাসসিরা! তোমার সব শর্তই মাথা পেতে নিলাম। সুলতানা ফুপাতে ফুপাতে বললো।
আমি তো তোমাকে একথা বলছিনা যে, আমার ও আমার স্বামীর মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। মুদ্দাসসিরা বললো, আমি সেই মহান ঝান্ডার মর্যাদার কথা বলছি, যা মহলের ওপর পতপত করে উড়ছে এবং ফৌজ সেটা নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।