খাদেমা ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। মুদ্দাসসিরা হো হো করে হেসে উঠলো। খাদেমা এবার ভয়ে কুঁকড়ে গেলো।
ভয়ো পেয়ো না মেয়ে। শুধু এটা স্বীকার করো যে, এই বিষয় মিশ্রিত দুধ তোমাকে সুলতানাই দিয়েছে। মুদ্দাসসিরা গম্ভীর গলায় বললো।
হ্যাঁ, উনিই দিয়েছেন। খাদেমা কম্পিত কণ্ঠে বললো এবং এগিয়ে গিয়ে হাত জোড় করে বললো, আমিই এই দুধ পান করবো। আমাকে দিন। যে শাস্তি ও যন্ত্রণা আমার জন্য অপেক্ষা করছে, এর চেয়ে এটা পান করে এখনই মরে যাওয়া অনেক ভালো।
মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
তার হুকুম না মানলেও আমার জন্য বড় শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। এখন হুকুম মেনেও এর চেয়ে বড় শাস্তির সামনে পড়তে হবে।
মুদ্দাসসিরার পায়ে পরে গেলো খাদেমা এবং মাথা তার পায়ে রেখে বললো,
আমার সন্তানদের ওপর রহম করুন রানীজি! আমাকে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিন। মহল থেকে আজীবনের জন্য চলে যাবো। কর্ডোভা থেকে বেরিয়ে যাবো।
তুমি মহলেই থাকবে। মুদ্দাসসিরা বললো, তোমাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। বাইরে দাঁড়িয়ে আমার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। কারো সাথে কোন কথা বলতে পারবে না।
মুদ্দাসসির দুধের পাত্র নিয়ে খাদেমাকে ওখানেই রেখে বেরিয়ে গেলো।
***
হেরেমের মেয়েদের দিন শুরু হয় বাইরে সূর্যাস্তের পর থেকে। সুলতানার কামরায় রঙবেরঙের অসংখ্য ফানুস জ্বলছে। দিনের আলোর চেয়ে ঘর উজ্জল হয়ে আছে। পুরো ঘর এমন সুগন্ধিতে ভরে আছে, সাধারণ মানুষ তা কল্পনাও করতে পারবে না।
সুলতানা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছে আর নিজের রূপের ছটা দেখে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছে।
মুদ্দাসসিরা চাপা পায়ে কামরায় ঢুকলো। আয়নায় মুদ্দাসসিরাকে দেখে সুলতানা চমকে উঠলো। পেছনে ফিরে কয়েক মুহূর্ত শুধু ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো। ওকে এখন সে এখানে মোটেও আশা করেনি। মুদ্দাসসিরার দুঠোঁটে মুচকি হাসি।
আরে মুদ্দাসসিরা! কিভাবে এলে? সুলতানা উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, এই পাত্র কিসের?
এর মধ্যে দুধ আছে। আর এর সঙ্গে এমন মধু মেশানো আছে যা কেবল মিসরেই পাওয়া যায়। তাও ফেরাউনের যুগের কোন কোন পোড়া এলাকায়। মুদ্দাসসিরা দুধের পেয়ালা দারুন সুদৃশ একটি টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললো,
এই দুধের বৈশিষ্ট্য হলো, দুধের মধ্যে সামান্য একটু মিশিয়ে কোন মেয়ে পান করলে তার রূপ কয়েখগুণ বেড়ে যায়। আর কিশোরীদের মতো হয়ে উঠে তার শরীর, রূপ-লাবন্য। হেরেমের এক খাদেমার ভাই এটা মিসর থেকে নিয়ে এসেছে।…..
খাদেমা দুধে মিশিয়ে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। আমি পান না করে তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। তোমার রূপ লাবন্য ও যৌবনের সঙ্গে আমীরে উন্দলুসের যে প্রেম রয়েছে আমি চাই সেটা আজীবন অটুট থাকুক। আমি আমার স্বামীকে আনন্দময় দেখতে চাই। নাও, তুমি পান করে নাও। আমার দেহের প্রতি তো আর ওর এত আকর্ষণ নেই।
সুলতানার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে কিছু একটা বলতে চাইলো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোলো না। তার রূপের ঝাঁঝ যেন নিমিষেই উবে গেলো। সে জানে সে এক ভয়াবহ অপরাধ করেছে।
সুলতানা! মুদ্দাসসিরা বললো সুলতানার মুখের দিকে তাকিয়ে। লোভ, মোহ, নোংরা, প্রতিদ্বন্ধিতা আর বিদ্বেষ মানুষকে একদিন না একদিন সেখানে নিয়ে দাঁড় করায় যেখানে আজ তুমি দাঁড়িয়ে আছে। তোমার মুখের অদৃশ্য রেখাগুলো বলছে, এই বিষের পেয়ালা তুমি নিজেই পান করবে একদিন। এখনো কি তুমি তোমার অবস্থান কোথায় সেটা বুঝতে পারোনি?
আমি আমীরে উন্দলুসের স্ত্রী আর তুমি তার রক্ষিতা! তুমি এখন এমন এক অপরাধে অপরাধী যে তোমার অলীক স্বপ্ন, তোমার ভাগ্য, তোমার গর্বের সন্তানের ওপর কালিমার মোহর মেরে দিয়েছো। তোমার চরম উগ্রতা, ঝড়ের মতো দাপট, নদীর বানের মতো উচ্ছলতা, রূপের চরম অহংকার এখন কোথায় গেলো?
সুলতানার যেন মাথা ঘুরে গেছে। ধরাম করে সে খাটের ওপর বসে পড়লো আর নির্জবী চোখে মুদ্দাসসিরার দিকে তাকিয়ে রইলো।
এখন কেন বলছো না এই বিষের পেয়ালা তুমি পাঠাওনি। মুদ্দাসসিরা বিদ্রুপাত্মক হেসে বললো, মিথ্যার ওপর যার গোটা জীবনের অস্তিত্ব তার কেন মিথ্যা বলতে এত দ্বিধা! যার হাতে তুমি বিষের পেয়ালা পাঠিয়েছে সে আমারই খাদেমা। নিজেও সে বেঁচে থাকতে চায় এবং তার সন্তানদেরও জীবিত দেখতে চায়। তোমার অবৈধ বখশিশের লোভ এবং তুমি এখানে যে প্রেতাত্মার মূর্তি বানিয়ে রেখেছে তার ভয়ে সে তোমার কথা মানতে বাধ্য হয়।…
কিন্তু আমি যখন ওর সঙ্গে স্নেহের সুরে দুচারটি কথা বলি তখন তার কয়েদখানার জাহান্নামের কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে তাকে আজীবন পঁচে মরতে হবে। তার সন্তানের কথা মনে পড়তেই সে আমার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে এই বিষের মূল্যবান কাহিনীর পুরোটাই আমাকে বলে দেয়। আমাকে নয়: তুমি নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করো, তোমার অবস্থান আস্তুকুড়ের কতটা নিচে?
এখানকার কোন খাদেমা, কোন খাদেম এমনকি কোন রক্ষিতাও আজ পর্যন্ত শাহী খান্দানের কাউকে কোন ধোঁকা দেয়নি। সত্য-মিথ্যা কোনটাই বলার সাহস নেই তোমার মধ্যে। ফায়সালার ভার তোমার ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। যদি বলো, এখনই তোমার জীবনের শেষ রাত বানিয়ে দেবো, আর চাইলে তোমাকে তোমার প্রাণও ভিক্ষে দিতে পারি। এই রূপ যৌবন তোমার আর কোন কাজে লাগবে?