সুলতানা ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলো। সামনে আবদুর রহমান দাঁড়ানো। এর আগে তার চোখ মুখ রাগে থমথমে হয়েছিলো। সুলতানার প্রতি নজর পড়তেই তার সেই থমথমে ভাব নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
সুলতানার রূপের জাদু পথম দেখাতেই তার কারিশমা দেখিয়েছে। আবদুর রহমান গারোয়ান ইউগেলিসের দিকে তাকালো।
অপরাধ নেবেন না শাহে উন্দলুস! ইউগেলিস ঝুঁকে পড়ে বললো, ঘোড়া তাবু থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। এই শিকারভূমির সীমানা সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিলো না।
আবদুর রহমান তার পুরো কথাও শুনলেন না। তার চোখ আটকে গেলো সুলতানার চেহারায়।
শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে আমার কোন আফসোস হচ্ছে না। কে তুমি মেয়ে? আবদুর রহমান সুলতানাকে জিজ্ঞেস করলেন।
মালিকায়ে তরূব। সুলতানা বললো, আমার নাম সুলতানা।
কোন দেশের মালিকা-সম্রাজ্ঞী?…..তোব কোন দেশ?…..আবদুর রহমান তার লোকদের দিকে জিজ্ঞাসু সৃষ্টিতে তাকালেন।
তরূব আসলে একটি জায়গীর। কোন দেশ নয় তরূব। কেউ একজন জানালো।
সুলতানা তাকে জানালো, তার বাবা মারা গেছে। এখনো তার বিয়ে হয়নি। এখন সে তার বাবার জায়গীরের মালিক।
তুমি সত্যি সত্যিই সম্রাজ্ঞী হতে পারো। আবদুর রহমান বললেন, তুমি সদ্য যুবতী মেয়ে। নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিজেই ফয়সালা করতে পারো।…..আমার বিশ্বাস, তমি বুঝে গেছো আমি কি বলতে চাচ্ছি।
বুঝে গেছিশাহে উন্দলুস! সুলতানা মুচকি হেসে বললো, এতটুকু ইশারা ইংগিত তো বুঝাই যায়।
এক ঝর্ণার ধারে দারুণ সুসজ্জিত একটি তাঁবু খাটানো হয়েছে। সুলতানাকে সেখানে নিয়ে গেলেন আবদুর রহমান। সেখানে রাজকীয় দস্তরখান সাজানো ছিলো। সুলতানাকে নিয়ে তিনি দস্তরখানায় বসলেন। ইউগেলিসও সঙ্গে রইলো। দস্তরখানায় পাখির ভূনা গোশত ও একটি হরিনের রানের রোষ্ট পরিবেশন করা হলো। হরিণটি কিছুক্ষণ আগে আবদুর রহমান শিকার করেছেন।
খুশিতে আবদুর রহমানের ভেতরটা ঝন ঝন করে উঠছিলো। তার আশাতীত প্রিয় এক শিকার মিলে গেছে। সুলতানাকে দেখে দেখে তিনি নিশাকাতর হয়ে উঠছিলেন।
***
এই নেশা আবদুর রহানের ওপর সবসময় ছেয়ে রইলো। সুলতানা তার বিবাহিত স্ত্রী না হয়েও মহল, হেরেম ও আবদুর রহমানের শয়নকক্ষে একক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করলো।
ইতিহাসও তার ব্যাপারে কলম ধরতে বাধ্য হয়েছে,
সুলতানার রূপ-সৌন্দর্য তার দেহে কুদরত যেন নিজ হাতে ভরে দিয়েছেন। এই মেয়ে যেমন সুন্দরী ছিলো তেমনি চতুর ও কুচক্রী ছিলো। কুটিল বুদ্ধি তার রগরেশায় পরিপূর্ণ হয়ে ছিলো। দারুন সৌখিন ছিলো। তেমনি ছিলো চঞ্চলা…..।
নিজেকে এমন সুক্ষ্ম উপস্থাপনায় বাদশাহর সামনে তুলে ধরতো বাদশাহ তার পায়ে এসে প্রায় আছড়ে পড়তেন। এই অবাধ্য যৌবন আর অনাচারী রূপ আবদুর রহমানকে মালিকায়ে তরূবের জন্য পাগল দিওয়ানা করে রাখে।……….
রূপ-যৌবনের ব্যবহার সে এমন নিষ্ঠুরভাবে করতো যে, একবার আবদুর রহমান তাকে উপহার-উপঢৌকন হিসাবে এত বেশি দিরহাম দীনার দেন যে, খাজাঞ্চীও আর্তনাদ করে উঠে।…..
একবার শাহে উন্দলুসের প্রতি অভিমান করে সে তার কামরার দরজা বন্ধ করে রাখে। এটা দেখে শাহ আবদুর রহমানের অবস্থা ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলো। তিনি তার কয়েকজন গোলামকে মালিকায়ে তরূবের কাছে পাঠান যে, তারা অনুনয় বিনয় ও তোষামোদ করে বাদশাহকে তার কামরায় আসার অনুমতি আদায় করে নিয়ে আসে। কিন্তু মালিকা কারো কথাই শুনলো না।…..
তখন বাদশাহর প্রধানমন্ত্রী ও দুজন উপদেষ্টা তাকে পরামর্শ দিলো, এমন সাধারণ একটি মেয়ে এভাবে জিদ ধরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে যে, বাদশাহর ইযযত সম্মানের প্রতিও সে ভ্রূক্ষেপ করছে না। তাহলে তো উচিত তার দরজার সামনে ইটের দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেয়া। যাতে সে ভেতরেই দম বন্ধ হয়ে মরে যায়।……
আবদুর রহমান এ পরামর্শ তো গ্রহণ করলেনই না, বরং যারা এ ধরনের পরামর্শ দিলো তাদের ওপর চটে উঠে হুকুম দিলেন, মালিকায়ে তরূবের দরজার সামনে দিরহামের থলে এমনভাবে একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখো যেমন দেয়াল তোলার সময় ইট নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত গেঁথে দেয়া হয়। আরো হুকুম দিলেন, সবচেয়ে মূল্যবান মোতির স্তূপ যেন দরজার সামনে এনে ফেলা হয়।…..
তার হুকুম পালন করা হলো। আবদুর রহমান মালিকায়ে তরূবের দরজায় গিয়ে তাকে ডেকে বললেন, দরজা খুলে দেখো, তোমার দরজার সামনে কী? এসব ধনদৌলত সবই তোমার জন্য।
দরজা খুলে গেলো। মালিকায়ে তরূব তো এই খেলার দক্ষ খেলোয়াড়। সঙ্গে সঙ্গে আবদুর রহমানের পায়ে আছড়ে পড়লো। তার হাতে চুমু খেলো। এমন ভাব দেখালো যেন সে বাদশাহর প্রেমে অন্ধ।….
অন্ধ তো হয়ে গেছে আবদুর রহমান। যিনি এটাও দেখলেন না মালিকায়ে তরূব আনলে কিসের প্রেমিক। সে বাদশাহের হাতে চুমু খেলেও প্রথমেই কিন্তু বাদশাহকে তার কামরায় নিয়ে গেলো না। আগে দিরহাম ও মোতির থলেগুলো কামরায় উঠিয়ে রেখে তারপর বাদশাহকে তার কামরায় নিয়ে গেলো।
***
মহলজুড়ে কানাঘুষা চলতে লাগলো। হেরেমের মেয়েরা দাঁত দিয়ে পিষে পিষে তাদের আঙ্গুল দংশন করতে লাগলো। সবাই তো আবদুর রহমানকে অতি কঠোর লড়াকু বাদশাহ বলে জানতো। সে বাদশাহকে যে মেয়ে এভাবে তার গোলাম বানিয়ে নিয়েছে তার হাতে নিশ্চয় কোন জাদু আছে। তাকে কেউ কেউ জাদুকরও বলতে শুরু করলো।