যাবিয়াব আসলে ইরানের অধিবাসী ছিলো। তার আসল নাম আলী ইবনে নাফে। উপনাম আবুল হাসান। কিন্তু যারিয়ার নামেই সে বিখ্যাত হয়ে উঠে। যাবিয়াব বিশ্ববিখ্যাত এক গায়ক হয়ে উঠে। পৃথিবী বিখ্যাত আরেক সঙ্গীতজ্ঞ ইসহাক আল মুছিলী তার সঙ্গীতগুরু। খলীফা হারুনুর রশীদের দরবারী গায়ক ছিলেন ইসহাক মুছিলী।
কিন্তু যারিয়াবের সুরে যে আশ্চর্য শক্তি ও রাগ-রাগিনী সম্পর্কে তার যে অগাধ জ্ঞান ছিলো সেটা দিয়ে তার গুরু মুছিলীকেও সে অতিক্রম করে গিয়েছিলো। যারিয়াব শুধু দরবারী গায়ক বা সঙ্গীতজ্ঞই ছিল না। দেখতে দারুন সুদর্শন। ইতিহাস ও দর্শনে দারুন পান্ডিত্য ছিলো তার। কথা বললে সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনতো এবং খুব দ্রুত তার মতাবলম্বী হয়ে উঠতো।
তার ব্যাপারে এমন জনশ্রুতিও ছড়িয়ে পড়ে, তার দখলে কোন জিন বা অশরীরী কিংবা অপার্থিব কোন শক্তি রয়েছে।
এক সময় সে আফ্রিকা চলে যায়।
আবদুর রহমানের বাবা আলহাকাম তার খ্যাতির কথা শুনে তার দরবারের এক ইহুদী গায়ককে আফ্রিকা পাঠিয়ে দেন যারিয়াবকে নিয়ে আসতে। কিন্তু যাবিয়াব কর্ডোভা তখন পৌঁছে যখন আলহাকামের মৃত্যু হয়ে গেছে এবং আবদুর রহমান ছানী শাসন ক্ষমতার লাগাম নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছেন।
যারিয়াবকে হতাশ হতে হয়নি। কারণ, আবদুর রহমানও তার বাবার মতো দারুণ সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন। তিনি যারিয়াবকে পেয়ে বুকে তুলে নেন। যারিয়াব খুব অল্প দিনেই পুরো রাজদরবারে প্রভাব বিস্তার করে। সে যে শুধু একজন সঙ্গীতজ্ঞই নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন ইতিহাসে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি সেটাও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।
দুই তিন দিন পর আবদুর রহমান শিকারে গেলেন। যে বনজঙ্গলে তিনি শিকার করতে গেলেন সেখানে অনেক হরিণ রয়েছে। মুহাফিজ ও রাজকর্মচারীসহ অনেক লোক রয়েছে তার সঙ্গে।
আবদুর রহমান ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হাতে তীর ধনুক নিয়ে একটি হরিণকে ধাওয়া করলেন। কিন্তু এসময় একটু দূরে একটি ঘোড়ার গাড়ি দেখা গেলো। গাড়ির সামনে দুটি সাদা ঘোড়া জুড়ে রয়েছে।
এক মুহাফিজ ঘোড়ার গাড়িটি সেখান থেকে দূরে হটানোর জন্য সেদিকে তার ঘোড়া ছুটালো। সেই ঘোড়ার গাড়ির রুখ সেদিকে রইলো যেদিকে আবদুর রহমান যাচ্ছিলেন। তিনি জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে সেই সাদা ঘোড়া দুটি ভয় পেয়ে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে। নিচের জমি সমতল নয়। তাই ঘোড়ার গাড়িটি ডানে বামে কাত হয়ে যাচ্ছে।
আবদুর রহমান তার মুহাফিজদেরকে হুকুম দিলেন, গাড়ির ঘোড়া দুটিকে থামাতে। তিন চার মুহাফিজ সেদিকে ঘোড়া ছুটালো। গাড়ির ঘোড়াগুলো তাদের দিকে কয়েকটি ঘোড়া ছুটে আসতে দেখে দিকবিদিক হয়ে ছুটতে শুরু করলো। গাড়োয়ান ঘোড়ার লাগাম ধরে তার দিকে সমানে টানছিলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভেতর থেকে এক নারীর চিৎকার ভেসে আসতে লাগলো। কখনো কখনো তার ভয়ার্ত মুখ বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগলো। পরমুহূর্তেই সেটা আবার গাড়ির ভেতর হারিয়ে যেতে লাগলো।
মুহাফিজরা সেনাবাহিনীর লোক। তারা তাদের ঘোড়া ছুটাতে ছুটাতে গাড়ির সাদা ঘোড়ার পাশাপাশি নিয়ে গেলো। তারপর দুই মুহাফিজ তাদের ছুটন্ত ঘোড়া থেকে গাড়ির ঘোড়া দুটির ওপর প্রায় লাফিয়ে গিয়ে সওয়ার হলো। তারা দক্ষতার সঙ্গে ঘোড়ার লাগাম ধরে আস্তে আস্তে ঘোড়া দুটিকে শান্ত করে ফেললো এবং ঘোড়া শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
গাড়ি থেকে অতি রূপসী একটি মেয়ে নেমে এলো। নেমেই মুহাফিজদের শুকরিয়া আদায় করলো।
তার মুখ এখনো ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। সে হাফাচ্ছিলো। গাড়োয়ানের অবস্থা এর চেয়ে আরো ভয়াবহ।
মুহাফিজরা তাকে বললো এটা শাহে উন্দলুস ও শাহী খান্দানের শিকারক্ষেত্র। তাদের গাড়ি কি করে এদিকে এলো?
মেয়েটি বললো, এটা তার জানা ছিল না যে, এই বনভূমি শাহী খান্দানের শিকারক্ষেত্র। মুহাফিজরা বললো, তাকে শাহে উন্দুলুসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি হুকুম দিয়েছেন, গাড়ির ঘোড়া দুটি নিয়ন্ত্রণে এলে গারোয়ান ও যাত্রীকে যেন তার সামনে হাজির করা হয়।
মুহাফিজদের ঘোড়া চলতে লাগলো আগে আগে। এর পেছন পেছন চলছে ঘোড়ার গাড়িটি। গাড়ির ভেতর থেকে মেয়েটি গারোয়নের দিকে মুখ বের করে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
ইউগেলিস! আমার ঘোড়া কি আসলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। আমার তো ভয়ে রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছিলো।
ইউগেলিস নিঃশব্দে হেসে উঠলো এবং নিচুগলায় বললো,
আমার কারিশমার প্রশংসা করো সুলতানা! ঘোড়া প্রথমে মোটেও লাগাম ছাড়া হয়নি। আমি ঘোড়া ছুটিয়েছিই এমনভাবে যে, দূর থেকে যে দেখবে সে মনে করবে ঘোড়া মনে হয় লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে।…..
হ্যাঁ, আমি যে সংবাদ পেয়েছি, আবদুর রহমান শিকার করতে আসছেন এটা সঠিক বলেই প্রমাণিত হলো। এখন ওরা তোমাকে তার সামনে নিয়ে যাচ্ছে। এই শিকার ক্ষেত্রের বনভূমিতে ঢুকে পড়া অপরাধ। আমার কৃতিত্ব তুমি দেখেছো। এখন তোমার কৃতিত্ব দেখাও।
***
শাহী মহলেও ইউগেলিসের লোক রয়েছে। সে লোকই সময়মতো তাকে খবর দেয়। অমুক দিন শাহে উন্দলুস অমুক বনভূমিতে শিকার করতে যাচ্ছেন। এ খবর পেয়ে ইউগেলিস সুলতানাকে নিয়ে সব পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে। সে অনুযায়ী কয়েকবার রিহার্সেলও করে নেয়।