কে তুমি? সুলতানা হয়রান হয়ে রাগত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, এখানে কি নিতে এসেছো? তোমার কি এতটুকু ভয় নেই যে, আমি তোমাকে হত্যা করিয়ে তোমার লাশ গায়েব করে দিতে পারবো?
লোকটি ভয় না পেয়ে অভয়ের হাসি হেসে বললো,
আমার নাম ইউগেলিস–সুলতানা মালিকা! ছদ্মবেশ ধারণ করেছি এজন্য যে, তোমার কাছে আসার সহজ আর কোন পদ্ধতি ছিলো না এবং এটা নিরাপদও। আমি এমন কোন উদ্দেশ্যে এখানে আসিনি যে, তুমি আমাকে হত্যা করাবে। আমার ছদ্মবেশ ধরা পড়ে যাওয়ার পরও সে কথাই বলবো যা এতক্ষণ বলে এসেছি। ধর্মের কথা এজন্য বলেছি, তোমার ওপর যদি ইসলামের প্রাধান্য দেখতাম তাহলে এই ছদ্মবেশেই এখান থেকে চলে যেতাম।
তুমি আমাকে কি খ্রিষ্টান বানাতে এসেছো?
না সুলতানা! তুমি এখন যেমন মুসলমান আছো তেমন মুসলমানই থাকবে এবং সম্রাজ্ঞী হওয়ার পরও মুসলমানই থাকবে। ইউগেলিস আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।
ইউগেলিস তার পকেট থেকে আলতো করে একটি হার বের করলো। এতে খচিত মনিমুক্তাগুলো থেকে বিচিত্র বর্ণের আলো ঠিকরে বেরোতে লাগলো। হারটি সুলতানার সামনে তুলে ধরে বললো,
এমন হার কখনো দেখেছো? এমন হীরা-মনিমুক্তা কখনো দেখেছো? এমন হার কোন সম্রাজ্ঞীর গলাতেই দেখা যায়।
হারটি সুলতানার দিকে এগিয়ে ধরে ইউগেলিস বললো,
এটা তোমার জন্য উপহার…..জানেনা এটা কে পাঠিয়েছেন? শাহে ফ্রান্স শাহ লুই। এটা তোমার জন্যই।
সুলতানার চোখের মণি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। তার ঠোঁট দুটি নিমিষেই শুকিয়ে গেলো। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে রইলো। সে এমন দুর্মূল্যের হার কখনো দেখেনি। তার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না এমন একটি হারের মালিক এখন সে এবং এটা পাঠিয়েছেন কোন বাদশাহ।
শাহ লুই কি চান? সুলতানা নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো। তার ক্ষণিক আগের লোপ পাওয়া বিবেক বুদ্ধি আবার জেগে উঠলো। মনে পড়ে গেলো, সে অতি সুন্দরী এক যৌবনময়ী মেয়ে। যার রাজা বাদশাহদের কাছেও উঁচু মূল্যের চাহিদা আছে।
তিনি তোমাকে নিজের মালিকা বা রানী বানাতে চান না। ইউগেলিস সোজা সাপ্টা কথা পাড়লো, তিনি তোমাকে একটি আস্ত অঙ্গরাজ্য দিতে চান। তোমাকে কোন ধোকাও দেয়া হবে না এবং তোমার সঙ্গে কেউ প্রতারণাও করবে না। বরং তোমাকে এক থোকা ও প্রতারণার বাস্তব প্রতিমূর্তি বানানো হবে।
আর আমাকে শাহে উন্দুলুসের মহলে ঢুকিয়ে তাকে ধোকা দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে? সুলতানা বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললো, আমি তোমার সাহসের প্রশংসা করছি। কারণ, আমি যে তোমাকে গ্রেফতার করিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারি সে ভয়টুকুও তোমার মধ্যে নেই। কিংবা সে বাস্তব জ্ঞানটুকুও তুমি রাখো না।
এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তুমি জীবিত থাকলে তো! ইউগেলিস শীতল গলায় বললো, আমার মুখ একটি। হাত ও বাহু অনেক। আমি একা নই। পুরো একটা শক্তিশালী দল ছায়ার মতো আমার সঙ্গে রয়েছে। তুমি শুধু আমাকে দেখছো, আমার ছায়া দেখার মতো শক্তিশালী দৃষ্টি তোমার নেই।
***
আমি যতটুকু মাটির উপরে আছি এর চেয়ে অধিক মাটির গভীরে আর অস্তিত্ব শিকড় গেড়ে আছে। ইউগেলিস বুক টান টান করে বললো, আমাকে গ্রেফতার করানোর মতো বোকামি কখনোই তুমি করতে পারবে না। আমি তোমার ভবিষ্যৎ চমকাতে এসেছি। এই কেয়ামত নামানো রূপ থেকে ফায়দা উঠাও সুলতানা!…..
তোমার চেহারায় যা আজ বিদ্যুতের মতো চমকাচ্ছে। এ চমক ক্ষণকালের। একসময় এই চমক তোমার কেবল স্মৃতির সঙ্গী হয়ে থাকবে। আমরা তোমার কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছি না। অনেক কিছু দিচ্ছি বরং তোমাকে। আবদুর রহমান তার চোখের মণিকোঠায় তোমার আসন দেবেন। তাকে যদি তোমার দেওয়ানা বানাতে পারো সেটা হবে তোমার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব প্রদর্শন।
তুমি যদি বলো আমি নিজেই তার মহলে গিয়ে হাজির হবো তাহলে কিন্তু এটা আমি মানতে পারবো না। তাছাড়া আমি নিজে গেলে তো আমার মূল্যও কমে যাবে। সুলতানা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো।
তাকে তোমার রূপের ঝলক দেখানোর কাজ আমাকেই করতে হবে। ইউগেলিস তাকে আশ্বস্ত করে বললো, শুধু বলো তুমি আমার সঙ্গে আছো। বাকি কাজ আমার।
আমাকে কি করতে হবে?
আবদুর রহমানের ওপর নেশা বিস্তার করতে হবে। তিনি তার তিন অতি রূপসী পরিচারিকার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। তাদেরকে তুমি প্রতিদ্বন্ধী মনে করবে না। বরং ওদেরকে হাতে নিয়ে আবদুর রহমানের সব প্রতিভা আর যোগ্যতা শেষ করে দেবে। তিনি সাধারণ লোক নন। তিনি যদি নারীদের মোহময় পরিবেষ্টন ও রাগ-রঙ থেকে বেরিয়ে আসেন তাহলে পুরো খ্রিষ্টজগতের ওপর তিনি এক আতংক হয়ে ছেয়ে যাবেন।…..
তাকে বাস্তবতা থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রায় অজ্ঞ-অসচেতন করে রাখতে হবে তাকে। বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা বা অচেতন করা যাবে না,–এর বিনিময়ে তুমি যা পাবে সেটা হবে তোমার স্বপ্ন ও কল্পনার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।
আমি রাজি। সুলতানা অধীর আগ্রহ নিয়ে বললো।
এখন শোনো! তোমাকে কি করতে হবে। ইউগেলিস বললো এবং তার পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত তাকে বোঝাতে লাগলো।
***
যে রাতে রূপের এমন ভয়াবহ জাদুতে ভরা চক্রান্ত হচ্ছিলো সালতানাতে উন্দলুসের বিরুদ্ধে, সে রাতে সালতানাতে ইসলামিয়া উন্দলুসের কর্ণধার আবদুর রহমান ছানী ডুবে ছিলেন সুন্দরী নারীদের রূপ যৌবনের অতল সমুদ্রে। আর মগ্ন ছিলেন যারিযাবের মন উন্মাতাল করা গান ও নর্তকীদের নৃত্যকলায়।