হ্যাঁ, দরবেশ নির্বিকার কণ্ঠে বললো, এবং কিছু বলার জন্যও। মালিকার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্যও।
কি বলার জন্য?
এতগুলো মানুষের সামনে বলবো কি করে যাদের রাক্ষুসে চোখ মালিকার চেহারা চেটেপুটে খাচ্ছে। ওদের সামনে কি দরবেশ কিছু বরতে পারে? দরবেশ সকৌতুকে বললো, দেখুন মালিকায়ে তরূব! পথচারীরা কেমন করে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে?
আমি মালিকাকে সে পথ দেখাতে চাই যে পথে চললে এসব লোক মালিকাকে এভাবে অভব্যের মতো নগ্ন চোখে দেখবে না, বরং তাদের দৃষ্টি থাকবে মাটির দিকে এবং মালিকার সম্মানে তাদের মাথা অবনত থাকবে। উন্দলুসের সিংহাসনে মালিকার জন্য জায়গা খালি রয়েছে।
তুমি যদি কোন গনক হও এবং ভবিষ্যতের পর্দা উঠাতে পারো তাহলে আজ রাতে আমার ওখানে চলে এসো। দারোয়ান তোমাকে বাধা দেবে না।
***
রাতে দরবেশকে দারোয়ান বাঁধা দেয়নি। বরং সসম্মানে সুলতানার কামরা নিয়ে গেলো। কামরায় সুলতানা ছাড়া আর কেউ ছিলো না।
সুলতানার গায়ে তখন রেশমী কাপড়ের পোষাক। যেটা তাকে আবৃত নয়, অনেকখানি নগ্নই করে রেখেছে। ওর খোলা চুল কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো। ঝুলানো ফানুসের আলোয় তার রূপ আরো কয়েকগুণ হয়ে যেন ঠিকরে পড়ছে।
ইতিহাসে এসেছে, সুলতানার আওয়াজ ছিলো দারুণ সুরেলা, তার চালচলন, অঙ্গভঙ্গি জাদুর মুগ্ধতায় ভরা, তার হাসিতে মদের ক্রমআচ্ছন্নতা। খোদা যেমন তাকে রূপ দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশি দিয়েছেন বুদ্ধির ক্ষিপ্রতা ও চতুরতা। তার দৃষ্টিতে- চাহনিতে সবসময় প্রেম ও ভালোবাসার ঝলক লেপ্টে থাকে। কিন্তু স্বভাবে সে দারুণ প্রতারণা প্রিয়। সে তার রূপের ব্যবহার জানে। জানে কি করে পুরুষকে বশ করা যায়। এসব তার কাছে ছিলো পানি পানের মতো সহজ।
দরবেশ তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও তার দৃষ্টি কেঁপে উঠলো ভূমিকম্পের কাঁপুনির মতো। তারপর তার দৃষ্টি ঘুরে এলো তার মুখের দিকে।
উন্দুলুসের সিংহাসনে আমার জন্য জায়গা খালি আছে এটা তুমি কি করে বললে? সুলতানা মালিকায়ে তরূব জিজ্ঞেস করলো।
এটা পরমাত্মার জগতের কথা মালিকা! দরবেশ বললো, আমি জানি, আপনি কোন সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হতে ব্যাকুল হয়ে আছেন। কিন্তু সে পথ আপনি খুঁজে পাচ্ছেন না। আজ পর্যন্ত এমন কাউকে আপনি পাননি যে আপনাকে সে পথটা দেখাবে।
তুমি যদি আমাকে সে পথ দেখিয়ে দাও তোমাকে আমি অর্ধেক জায়গীর পুরস্কারস্বরূপ দিয়ে দেবো।
আমার কোন নজরানা-পুরস্কারের প্রয়োজন নেই মালিকায়ে তরূব! আমার পায়ের তলায় ধনভান্ডার পড়ে আছে। কিন্তু সেটা বেকার। এসব আমার জন্য নয়। আমি অন্য কোন জগতের মানুষ।–শাহে উন্দলুস আবদুর রহমান ছানী আপনার প্রতীক্ষায় বসে আছেন।
কিন্তু তিনি আমাকে দেখেছেনই বা কবে? সুলতানা লোভাতুর কণ্ঠে বললো, শুনেছি মহলের তিন পরিচারিকা বাদশাহকে তাদের জালে জড়িয়ে রেখেছে। এও শুনেছি, আবদুর রহমান নাকি পাক্কা মুসলমান ও অতি উঁচু চরিত্রের মানুষ। তিনি আবার ভীষণ লড়াকু বাদশাহও। সম্ভবতঃ এ কারণেই তার পর্যন্ত আমার নাম পৌঁছেনি।
সুলতানার কথায় লোভ-মোহগ্রস্ততার নেশা ঝরে পড়ছিলো।
আমি মালিকা বা সম্রাজ্ঞী হবো একথা বলা ছাড়া কি তুমি আমার কোন সাহায্য করতে পারবে না? সুলতানা বললো, তুমি কি এমন কোন উপায় বলে দিতে পারবে না যেটা আমাকে সিংহাসন পর্যন্ত পৌঁছাবে। দরবেশ তো অনেক কিছুই করতে পারে।
আপনি আগে আমাকে বলুন, কোন মুসলিম বাদশাহর রানী হতে চান, নাকি…..
কথার মাঝখানে মালিকায়ে তরূব হেসে উঠলো এবং বললো,
আমার কোন স্বপ্ন কোন ধর্মের সঙ্গে জড়িত নয়। আমি যদি কোন ধর্মের আসল অনুসারী হতাম তাহলে এতদিনে কারো স্ত্রী হয়ে দুই সন্তানের মা হয়ে যেতাম।
তাহলে আমি আপনাকে যা বলবো তা আপনাকে করতে হবে। তা কি আপনি করতে পারবেন? দরবেশ জিজ্ঞেস করলো, একটি দেশের অঙ্গরাজ্য আপনার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সে রাজ্য কোন মুসলমানের হবে না। সেটা আপনি এর বিনিময়ে পাবেন যে, শাহে উন্দলুস আবদুর রহমান ছানীর মন মস্তিষ্কে আপনাকে চেপে বসতে হবে। অতি রূপসী এক ফানুস হয়ে তাকে অধিকার করতে হবে আপনাকে।
তারপর তাকে বাধ্য করবো, তিনি যেন আমাকে রাণী করে নেন?
না, দরবশ বললো, এমন করলে তিনি আপনাকে সম্রাজ্ঞী বা রানী নয়, তার স্ত্রী বানাবে। তারপর একদিন আপনার মোহ কেটে গেলে আপনাকে হেরেমে নিক্ষেপ করবেন। তারপর আরেকজন রানী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তার শয়নকক্ষে এসে হাজির হবে,–এভাবে চলতেই থাকবে। আমি আপনাকে একটা কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছি। আপনি সেটা প্রয়োগ করলে একদিন আপনি আপনার স্বাধীন অঙ্গরাজ্যের অধিকারী হবেন। সৈন্যসামন্তও থাকবে এবং আপনি স্বাধীনভাবে রাজত্বও করবেন।
সুলতানা অতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী। সে মনোযোগ দিয়ে দরবেশের কথা শুনছে। আর গভীর চোখে তার চেহারা নিরীক্ষা করছে। হঠাৎ সে চমকে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে দরবেশের দাড়ি ধরে সজোরে টান দিলো। দাড়ি গোড়া থেকে উঠে এলো। তার আরেক হাত দরবেশের মাথায় রাখলো এবং মাথার কাপড় তার হাতের মুঠোয় নিয়ে টানদিতেই এক ঝটকায় মাথার কাপড় ও মাথার দীর্ঘ চুল উঠে এলো।
***
মাথার চুল ও দাড়ির রঙ সাদা রঙ দিয়ে শুভ্র করে তুলেছিলো। এটা আসলে ছিলো ছদ্মবেশ। ছদ্মবেশ খসে যাওয়ার পর পূর্ণ এক যুবকের অবয়ব বেরিয়ে এলো।