নিজের বাদশাহী নিষ্কন্টক করার জন্য এক দুজন নয়, হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিলো নিরপরাধ। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন। ইচ্ছে হয়েছে তো হাজারো মানুষের ভিটে-বাড়ি, জায়গা জমি ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার জুরুম অত্যাচারের লক্ষ্যবস্তু যেমন সাধারণ জনমানুষ ছিলো তেমনি শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, আলেমে দ্বীন ও মুফতী সাহেবরাও ছিলেন।…..
রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র কায়েম রাখার জন্য যে কোন অবৈধ কলাকৌশল, অজুহাত, চক্রান্তকে বৈধ করে নিয়েছিলেন আলহাকাম। আলহাকামের কাল ছিলো একনায়কতন্ত্রীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থার এক ঘৃণ্য উদাহরণ। যেমন ইচ্ছে তেমন ভোগ করো এর কলংকজনক প্রতীক ছিলো আলহাকামের শাসনকাল।
***
আল হাকামের মৃত্যুর পর তার ছেলে আবদুর রহমান ছানী একত্রিশ বছর বয়সে উন্দুলুসের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন। তার ব্যাপারে ইতিহাসের মূল্যায়ন এরকম,
সাহিত্য, কাব্য কবিতার যত রথী মহারথী, গানবাদ্য ও নৃত্যকলার যত অভিজ্ঞ মুখ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত বড় বড় পন্ডিত আবদুর রহমানের দরবারে সমবেত হয় সেটা আর কোন কালের ইতিহাসে দেখা যায়নি। তবে আবদুর রহমান যেমন শিল্প-সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন তেমনি সঙ্গীতের প্রতিও ছিলো তার তীব্র আকর্ষণ।
একদিকে তিনি ছিলেন অতি তীক্ষ্ণধারী তলোয়ার চালনাকারী, যুদ্ধ ও লড়াইয়ে ক্ষিপ্র ও অভিজ্ঞ, অন্যদিকে ছিলেন সুন্দরী নারীর প্রতি অন্ধভাবে আসক্ত।
তার মহলের তিন পরমা সুন্দরী মেয়ের কাছে তার জীবন-যৌবন সঁপে রাখেন। এরা ছিলো তার মহলের পরিচারিকা। একসময় এরা হয়ে উঠে আবদুর রহমান ছানীর পরম প্রেমাস্পদ।
মুদ্দাসসিরা নামের পরিচারিকাটির রুপে মুগ্ধ হয়ে আবদুর রহমান তাকে বিয়ে করেন। আরেকজন ছিলো জারিয়া নামের পরিচারিকা। এ যেমন সুন্দরী তেমনি ছিলো তার কণ্ঠে জাদুমুগ্ধকারী সুর। আবদুর রহমান তার গান শুনতে শুনতে প্রহরের পর প্রহর কাটিয়ে দিতেন। আরেকজন পরিচারিকা হলো শিফা। এও ছিলো অতি রূপবতী। তার সিগ্ধ রূপ যে কোন পুরুষকে হতভম্ব করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
***
উন্দুলুসের সে রাতটি অন্যান্য রাতের মতোই সন্ধ্যা নামার পর ঘনিয়ে এলো। আবদুর রহমান শাহী মহলে গায়ক যারিয়াবের জাদুময় সুর মাধুরী সবাইকে মাতাল করে তুললো। সুন্দরী জারিয়াও আবদুর রহমানের পাশে বসে যারিয়াবের সঙ্গে সুর মিলাচ্ছে। শাহে উন্দলুস আব্দুর রহমান ছানী গান ও তার সুর লহরীতে এমনভাবে বিমুগ্ধ ও মগ্ন যে, তার মাথা থেকে এটা নেমে গেছে, তিনি সেই সালতানাতের সুলতান, সেই দেশের শাসক, যেখানে ক্রুশের পূজারীদের কালো ছায়া ক্রমেই চারদিক থেকে বিস্তার করে চলেছে।
এটা আর তার মনে রইলো না, ইসলামের সুমহান বাণী নিয়ে তাকে আরো অনেক দূর সফর করে যেতে হবে। এই শাহী মহলই তার শেষ গন্তব্য নয়। তাকে ইসলামী সাম্রাজ্রের সীমানা আরো দিগন্তপ্রসারী করে তুলতে হবে। যাতে পথহারা মানবজাতি আল্লাহর সত্যধর্মের আলোয় পথপ্রাপ্ত হয়।
সে রাতেই মালিকায়ে তরূব সুলতানার বাড়িতে এক দরবেশ পা রাখলো। সুলতানা এই দরবেশকে আগেও তার মহলের মতো বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। সুলতানা তার সাদা দুটি ঘোড়ায় জুড়ে রাখা গাড়িতে করে বৈকালিক ভ্রমণে বের হয়ে এই দরবেশকে প্রথমে দেখতে পায়। দরবেশ তার গাড়ির পাশ দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যায়। সুলতানার পাশে বসে থাকা তার এক সঙ্গী বলে উঠে,
এ লোকের মনে হয় মাথা খারাপ। পাগল। একে কয়েকবারই দেখেছি।
ভিখারীও হতে পারে। আরেক সখি বলে উঠে।
না। সুলতানা বললো, ভিখারী নয়। এর চোখেমুখে কি যেন একটা আছে। কথা শুনলে মনে হয় এ কোন সাধারণ দরবেশ নয়। আমি একে কাছ থেকেও দেখেছি। এর চোখে বুদ্দি ও জ্ঞানের দীপ্তি স্পষ্টতর হয়ে আছে। আমি কোন পুরুষের চেহারা চিনতে ভুল করিনি কোন দিন। এ আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।
দরবেশ হোক আর সাত মহাদেশের শাহেনশাহ হোক, তোমার রূপের জাদু সবাইকে সমানভাবে ঘায়েল করে ফেলে। সখির কণ্ঠে জলতরঙ্গ বেজে উঠলো যেন।
সুলতানা ঘুরে দেখলো, দরবেশ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি এই রূপের সম্রাজ্ঞীর শুভ্র অশ্বজোড়ার গাড়ির দিকে নিবদ্ধ। গাড়িটিকে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চলছে। সুলতানার গাড়িও সামনে এগিয়ে চলছে। সুলতানা তার বৈকালিক ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এলো। সূর্যাস্ত তখনো হয়নি।
দেখলো দরবেশ সেই আগের জায়গাতেই দাঁড়ানো। সুলতানার কৌতূহল বেড়ে গেলো। সে তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেললো। দরবেশকে চোখের ইশারা তার সামনে আসতে বললো। দরবেশ ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো।
তোমাকে আরো কয়েকবার এখানে দেখেছি আমি। সুলতানা জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো এবং জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি সব মেয়েকেই এমন গভীর দৃষ্টিতে দেখো যেমন আমাকে দেখছিলে?
দুনিয়ায় কিছু নারী আছে মালিকায়ে তরূব থেকেও আকর্ষণীয়া। দরবেশ সপ্রতিভ কণ্ঠে বললো, কিন্তু মালিকার রূপের আকর্ষণ মন-প্রাণ ও আত্মকেও ছাড়িয়ে যায়। আর যার রূপ আত্মাকে অতিক্রম করে যায় সে নারী মর্ত্যলোকের সেসব নারীর চেয়েও মহান যারা তার চেয়ে সুন্দরী।
তুমি কি আমাকে এভাবে দেখার জন্য আমার বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকবে।