***
যখন ফ্রান্সের রাজদরবারে সালতানাতে উন্দুলুসের ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চলছিলো; এরও এক শ চৌদ্দ বছর আগে এক যুবক সালার তারিক ইবনে যিয়াদ সাত হাজার ঈমানদীপ্ত সৈনিককে নিয়ে উন্দুলুসের তীরে নৌযান থেকে নামেন। তারপর সবগুলো নৌযান আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেন। তারপর তার সৈনিকদের উদ্দেশ্য যে ভাষণ দেন ইতিহাসের পাতায় এর প্রতিটি শব্দ আজো অক্ষয় হয়ে আছে। তারিক ইবনে যিয়াদ বলেছিলেন,
হে ইসলামের অকুতোভয় যুবকেরা। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর এখন আর কোন পথ খোলা নেই। তোমাদের সামনে শত্রুদল আর পেছনে সমুদ্র। পালানোর একমাত্র উপায়-অবলম্বন নৌযানগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরম ধৈর্য, দৃঢ়তা, কঠিন সংকল্প ও অপরাজেয় আদর্শ ছাড়া তোমাদের কাছে এখন আর কোন কিছুই নেই।
তোমরা জেনে রাখো, এই দ্বীপের মতো মহাদেশে (উন্দলুস চারদিক সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপের মতো) তোমাদের উদাহরণ এমন যেমন কৃপণের দস্তরখানায় অসহায় এতীমের অবস্থান। তোমাদের মনোবলে সামান্য ঘাটতি দেখা গেলেই তা মুহূর্তে ধ্বংস করে দেবে তোমাদেরকে। তোমাদের শক্রদলের সৈন্যসংখ্যা অগণিত এবং অস্ত্রশস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ।
আর তোমাদের কাছে তলোয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। শত্রদলের রসদ সংগ্রহের হাজারো উপায় ও পথ খোলা আছে। তোমাদের সে তুলনায় কোন উপায় ও পথ খোলা নেই। সে পথ তোমাদেরকেই করে নিতে হবে। তোমরা যদি দৃঢ় মনোবল ও অসীম বীরত্বের সঙ্গে কাজ না করো তাহলে তোমাদের পা উপড়ে যাবে। তখন মুসলিম জাতির নাম ধূলোয় লুটিয়ে যাবে। আর দুশমনের মনোবল বেড়ে যাবে।
নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধ ও ইসলামের ঝাণ্ডাকে উচ্চকিত রাখতে হলে একটি পথই খোলা আছে। সেটা হলো, যে শক্রদল তোমাদের মোকাবেলায় এগিয়ে আসছে, ভয়াবহ আতংক হয়ে তাদের ওপর ছেয়ে যাও। তাদের শক্তি খতম করে দাও। আমি তোমাদেরকে এমন কোন ব্যাপারে ভয় দেখাচ্ছি না, যেটার ব্যাপারে আমি নিজেকে নিজে আক্রান্ত বোধ করছি না। তোমাদেরকে এমন কোন ময়দানে লড়তে বলছি না যেখানে আমি নিজে লড়াই করবো না।…..।
আমীরুল মুমিনীন ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক তোমাদের মতো বীর বাহাদুরকে এজন্য বেছে নিয়েছেন যাতে তোমরা এ দেশের রাজা বাদশাহ ও আমীর উমরাদের কন্যাদের জামাই হতে পারো। এখানকার যুদ্ধবাজ শাহসওয়ারদের যদি তোমরা খড়কুটার মতো উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারো তাহলে এখানে আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে। এ মাটির জমাটবাঁধা হাজার বছরের অন্ধকার দূর করে তাকে আলো ঝলমলে করে তুলতে হবে। এটা মনে রেখো, যে পথে আমি তোমাদেরকে ডাকছি সে পথের প্রথম পথিক আমিই হবো।…..
দুপক্ষের সৈন্যরা যখন লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে তখন সবার আগে আমিই থাকবো। সবার আগে যার তলোয়ার দুশমনের ওপর আঘাত হানবে সেটা হবে আমার তলোয়ার। আমি শহীদ হয়ে গেলে তোমরা তো বিবেক বুদ্ধি দিয়েই কাজ করবে এবং আমার স্থলে অন্য কাউকে নির্বাচিত করে নেবে। তারপরও খোদার রাহে প্রাণ উৎসর্গ করতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যে পর্যন্ত আদিগন্ত বিস্তৃত এ এলাকা বিজয় না হবে সে পর্যন্ত তোমরা তলোয়ার হাত থেকে ছাড়বে না।
যেখানে দাঁড়িয়ে তারিক ইবনে যিয়াদ এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝলসানো শব্দগাঁথাগুলো উচ্চকিত করেছিলেন সেটা ছিলো একটি পাহাড়ের চূড়ার মতো জায়গা, ইতিহাস সে পাহাড়কে আজো স্মরণ করে জাবরাল্টা নামে।
এর আগে এ এলাকা জার্মানরা জয় করেছিলো। তারা নাম দিয়েছিলো আন্দালাস। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে যখন তারিক ইবনে যিয়াদের নেতৃত্বে আরবের সিংহরা এ দেশ জয় করলো তখন এর নাম দিলো উন্দলুস। পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, নদী, খাল বিল, ঝর্ণাধারা, বড় বড় শহর এমনকি অনেক গ্রামের নামও তারা পাল্টে ফেললো। সেখানকার পশ্চাদপদ ও বর্বরীয় সংস্কৃতি ধুয়ে মুছে পবিত্র করে এই দেশের অধিবাসীদেরকে এক আধুনিক ও সার্বজনীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি উপহার দিয়ে তাদেরকে আলোকিত করে তুললো।
***
তারপর তারিক ইবনে যিয়াদ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কেটে গেলো এরপর শতাব্দীকাল কিংবা আরো অধিক সময়। উন্দলুসের সিংহাসনে তারা এসে বসলো, যারা তাকি ইবনে যিয়াদ ও তার সাত হাজার সঙ্গীর রক্ত ঝরানো ইতিহাস হৃদয় মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছে।
মুজাহিদরা পবিত্র রক্ত দিয়ে ইতিহাসের যে সুবিশাল অধ্যায় রচনা করেছিলো, সিংহাসনের মোহগ্রস্তরা তার ওপর নিজেদের অসৎ কর্মের কালো পর্দা চড়িয়ে দিলো। যে রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা ছিলো আল্লাহর, তা হয়ে গেলো দিকভ্রান্ত মানুষের। যে দরবার ন্যায়-নীতি ও সততা বিমূর্ত প্রতীক ছিলো তা হয়ে গেলো অশ্লীল নর্তকীদের নিরাপদ নৃত্যক্ষেত্র।
সে দরবার হয়ে উঠলো উলঙ্গপনার রঙমহল। শাসকরা বনে গলো বাদশাহ। আর তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রইলো তোষামোদকারীরা। শাসকরাও তোষামুদে কথা শুনে পুলকিত হতে লাগলো।
৮২২ খ্রিঃ (২২৭ হিঃ সনে) উন্দলুসে এমনই একজন বাদশাহ মারা গেলেন। তার নাম আলহাকাম। তারীখে উন্দলুস নামক গ্রন্থে আলহাকামকে এভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছেঃ
আলহাকাম নিজের রাজ্যক্ষমতা ও ভোগবিলাসে মত্ত জীবন স্থায়ী করার স্বার্থে কুট-কৌশল, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও অবর্ণনীয় জুলুম অত্যাচার ও নির্যাতন নিপীড়নের পথ বেছে নিয়েছিলেন। না জনগণের ইযযত সম্মানের পরোয়া করেছেন, না তাদের জানমালের।…