ওদের দুজনকে কি ছেড়ে দেয়া হবে না-যাদেরকে উনারা ধরে নিয়ে এসেছেন? সুলতানা বললো, অমুসলিম প্রজারা না আবার বলে যে, ইসলাম এক জালিম ধর্ম।
হ্যাঁ, ওদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক। আবদুর রহমান বললেন।
হাজিব আবদুল করীম রাগে ফেটে পড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সালার আবদু ররউফও উঠলেন।
আমীরে উন্দলুস! হাজিব দরবারী আদব ও নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে বললেন, আপনি ভালো করে বিশ্রাম নিন। আমরা জীবিত আছি। ইসলামকে আমরা জীবন্ত রাখবো। ইসলামের হেফাজত করবে সেসব শহীদদের আত্মা যাদের লাশ আপনার দরজায় পড়ে আছে। আর যাদেরকে আপনি এক নজর দেখারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না।
আপনি না দেখুন আমীরে উন্দলুস! ওদেরকে আল্লাহ দেখছেন। সালার রউফ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন।
আপনারা বসুন। আবদুর রহমান এমন কণ্ঠে বললেন যাতে শাহী উত্তাপ ছিলো না, আমি আপনাদের কথা শুনছি। আমার কথাও আপনারা শুনুন।
উন্দলুস যদি আপনার জায়গীর হতো তাহলে আপনার হুকুম ছাড়া তো নিঃশ্বাসও নিতাম না। ওযীর আব্দুল করীম আবেগ-উত্তেজনায় আপ্লুত হয়ে বললেন, এটা আল্লাহর পবিত্র মাটি। ইসলাম এখনো এসে কাউকে ভয় পায়নি। কারো আক্রমণের শিকার হবে সে চাপও অনুভব করেনি। মাথা উঁচু করে রেখেছে সবসময়।…..
আমরা ইসলাম ও ইসলামী সালতানাতকে যে কোন ধরনের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখবো। এমনকি সে বিপদ বা আশংকা কিংবা অনিশ্চয়তা যদি আপনার পক্ষ থেকে ও হয় তবুও আমরা এর কোন পরোয়া করবো না।
আমি অনুতপ্ত, লজ্জিত যে, আমার কথা আপনাদেরকে যারিয়াব বলতে লাগলো।
আমাদের দৃষ্টিতে তোমার তো সামান্যতম মূল্য নেই? সালার রউফ তার কথা শেষ করতে না দিয়ে চরম ঘৃণা উপচানো কণ্ঠে বররেন, খেলাফত ব্যবস্থায় তোমার মতো চামচা জাতীয় লোককে কোন মূল্যই দেয়া হয় না। কিন্তু আমাদের সম্মিলিত দুর্ভাগ্য যে, তুমি অনেক কিছুই এখান থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তোমার ও এই মহিলার তো এই কামরায় থাকারও অধিকার ছিলো না। সালতানাতের বিষয়ে তোমাদের মতামতের তো কানাকড়িও মূল্য নেই।
আমরা যা ভালো মনে করেছি তাই করেছি। আমরা চলে যাচ্ছি। আমাদেরকে অপরাধী মনে করলে জল্লাদের হাওলা করে দেবেন। হাজিব বললেন।
দুজনই আবদুর রহমানের অনুমতি না দিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলেন।
দাঁড়াও তোমরা! আমি শহীদদের সবসময় সম্মান করি। আবদুর রহমান এবার দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।
তারা দাঁড়িয়ে পড়লেন। আবদুর রহমান উঠলেন এবং তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। এখন তার পদক্ষেপে লড়াকু দীপ্তি। সুলতানা ও যারিয়াবের প্রভাবমুক্ত তিনি এখন। তার ওপর কোন নেশা সওয়ার হয়ে নেই। তার দেহ ঋজু হয়ে গেলো। মাথা উঁচু হয়ে উঠলো।
আমি তো এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। আবদুর রহমান এক হাত আবদুল করীমের কাঁধে আরেক হাত আবদুর রউফের কাঁধে রেখে বললেন, আমি এই ঘটনার ব্যাপারে ভালো করে চিন্তাও করতে পারিনি।
জেগে উঠো আমীরে উন্দলুস! জেগে উঠো। দুশমন জেগে উঠেছে। হাজিব বললেন।
দুজনে আমীরে উন্দলুসকে সেখানেই রেখে বেরিয়ে গেলেন।
****
আবদুর রহমান জানালার বহু পরতের কচি দেয়া পর্দাগুলো সামান্য সরিয়ে বাইরে তাকালেন। সে সময় হাজিব ও রউফ শহীদদের লাশ উঠাচ্ছিলেন।
খ্রিষ্টানদের লাশ ও এই দুই কয়েদী এখানেই থাকবে? প্রহরী জিজ্ঞেস করলো।
শাহে উন্দলুস যে হুকুম দেবেন তাই পালন করবে। শুধু শহীদদের লাশ এখান থেকে যাচ্ছে। সালার রউফ বললেন।
আবদুর রহমান শহীদদের লাশগুলো যেতে দেখলেন। প্রতিটি লাশ কাঠের একেকটি তখতায় রাখা হলো। প্রতিটি তখতা চারজন করে সিপাহী বহন করছিলো। শহীদদের ছোট খাটো এই মিছিলটি বড় নিঃশব্দে যাচ্ছে। চার দিকের পরিবেশ বড় বিষণ্ণ, বড় শোক স্তব্ধ।
আবদুল করীম ও আবদুর রউফ লাশের পেছন পেছন যাচ্ছেন। শহীদদের সম্মানে তারা তাদের তলোয়ার কোষমুক্ত করে তাদের সামনের দিকে সোজা করে ধরে রেখেছেন। তাদের ঘোড়া তাদের সঙ্গেই রয়েছে। কিন্তু তারা যাচ্ছেন পায়ে হেঁটে।
তাদের পেছনে কয়েকজন সিপাহীও আসছে। তারাও তাদের বর্শাগুলো সোজা করে ধরে রেখেছে। কিন্তু তাদের চলার ভঙ্গি শোকস্তব্ধ নয়। তাদের গতি তীব্র। প্রতিটি পদক্ষেপ দৃপ্ত-কঠিন সংকল্পে সুদৃঢ়। আর যারা শহীদদের লাশ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তারা এমন ঋজুভঙ্গিতে চলছে যেন ওদের কাঁধে শহীদদের বোঝাই নেই।
আবদুর রহমান একবারও সেদিক থেকে দৃষ্টি সরাননি। তার কাছে মনে হচ্ছিলো, শহীদদের এই কাফেলার শোভাযাত্রা বুঝি শেষ হবে না।
তার অনুভূতিগুলো যেন তুমুল ঝড়ের কবলে পড়লো। তার রক্ত টগবগিয়ে উঠলো ঝড়ের তাণ্ডবে। জানালার পর্দা ছেড়ে তিনি ঘুরে গেলেন। তার চোখে মুখে নেশার কোন চিহ্ন নেই। যারিয়াব ও সুলতানা এতক্ষণ ওখানেই ছিলো। যারিয়াব তার মনোভাব বুঝে ফেললো।
উনারা যা বলেছেন এবং যা করেছেন সবই ঠিক করেছেন। যারিয়াব বললো আবদুর রহমানকে,
কিন্তু তাদের আপনার শাহী মান-মর্যাদাকে এমনভাবে উপেক্ষা করা উচিত হয়নি। আমি আমার ভুল মেনে নিচ্ছি শাহে উন্দলুস! কিন্তু মুহতারাম ওযীর ও সালারের এই আচরণকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
কেন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না? আবদুর রহমান দাপুটে গলায় বললেন, তারা পূর্ণ নৈতিকতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। আমার সঙ্গে তাদের ভব্যহীন আচরণকে শুধু আমি উপেক্ষাই করছি না, আমি ওদের শতভাগ প্রশংসা করছি।…..