যদি ঠিকঠাক বলে দাও, এসব ভেল্কিবাজি কি ছিলো তাহলে তোমাদেরকে ছেড়ে দেবো। প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম বললেন, আমরা তোমাদেরকে গ্রেফতার করবো না। এটা তো তোমাদের ধর্ম।
তোমরা তোমাদের ধর্মের জন্য যত প্রতারণা থোকাবাজি করো আমাদের কোন আপত্তি নেই। …..কিন্তু আমি অবশ্যই এটা জানবো যে, এটার মূলে কি ছিলো। যদি না বলো তাহলে এই জ্বলন্ত গির্জায় ফেলে দেয়া হবে। দুজনকে টেনে হেচড়ে জ্বলন্ত গির্জার এত কাছে নিয়ে যাওয়া হলো যে, আগুনের প্রচন্ড উত্তাপে ওদের চেহারা ঝলসে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।
আগুনের শো শো আওয়াজ বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার মতো। দুই খ্রিষ্টান পেছন দিকে সরে আসতে লাগলো। কেউ ওদেরকে বাধা দিলো না।
আমরা আপনাকে কখনো বলবো না এর পেছনে কার হাত রয়েছে? তাদের একজন বললো, আমরা আপনাকে কোনভাবেই বলবো না এর পেছনে কার হাত রয়েছে। যদি এর পরও জানতে চান তাহলে আমাদেরকে আগুনে ফেলে দিন। আমরা নিজেরাই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বো। একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে যে, সে তার ধর্মের জন্য তারই ইবাদতখানায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে?
সে ধর্মই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে যার অনুসারীরা তাদের পবিত্র ধর্মের জন্য জীবন্ত পুড়ে মরাকে অতি সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করে।…
অন্যজন অতি দুঃসাহসিক গলায় বললো, ইসলাম মৃত্যুবরণ করছে। আর খ্রিষ্টধর্ম পুনর্জীবন লাভ করছে। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।
এ ধরনের কথা বলতে ওদেরকে তো বাধা দেয়া হলোই না; বরং তাদেরকে উৎসাহ দেয়া হলো। ওদের মধ্যে যে যথেষ্ট জযবা-আবেগ আর বিচক্ষণতা রয়েছে এতে কারো কোন সন্দেহ রইলো না। বড় বড় কথা বা অবাস্তব কোন কথা ওরা বললো না।
পরিস্কার ভাষায় ওরা জানালো, সামনের প্রান্তরের শিলা পাথরের দেয়াল আর ঘন ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে তীব্র শিখাধারী ফানুস জ্বালানো হতো। এর ওপর গোল চিমনি রাখা হতো।
চিমনির তিন দিকে কালো রঙ করা। একদিক উন্মুক্ত। এদিক দিয়ে আলো বের হয়। যে কারণে আলো কোন দিকে না ছড়িয়ে শুধু সামনের দিকের গাছ পর্যন্ত পৌঁছে।
সামনের গাছের একটি ডালে একটা কাঠের এক হাত সমান টুকরো বেঁধে রাখা আছে। এর চারপাশে আয়না লাগানো। এর ওপর আলো পড়তেই সেটা ঠিকরে আলো বের হতো। এটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে বাতাসে মৃদু হেলতে দুলতো। এ থেকে কম্পিত আলো বের হতো। দূর থেকে দর্শকরা এটাকেই মনে করতো উজ্জল নক্ষত্র।
হযরত ঈসা (আ)-এর ব্যাপারে যেহেতু ভিত্তিহীন জনশ্রুতি আছে যে, তাঁর নূর যারা দেখবে তারা সেটা কোন গাছের শাখায় নক্ষত্র চমকানোর রূপে দেখবে। মানুষের এই কুসংস্কারের পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে এই খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী দলটি নাটক খেলে। এই কম্পিত আলোর সাহায্যে হযরত ঈসা (আ) এর ক্রুশে ঝুলানো ছবি তুলে ধরে। লোকেরা মনে করে, সত্যিই বুঝি ঈসা (আ) আত্মপ্রকাশ করেছেন। …..
এখন ধরা খাওয়ার পর এরা গির্জায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এর আগে ঈসা (আ) এর কাল্পনিক মূর্তিটি বের করে নিয়েছিলো।
সেই আহত জানবায সৈন্যটি মৃত্যুর আগে যে হাত উঁচিয়ে গাছের দিকে ইংগিত করে গিয়েছিলো, এতে আসলে সে এই কাঠের টুকরোটি দেখাতে চেয়েছিলো; যেটা চারপাশ থেকে কাঁচ সংযুক্ত। সেটা নামানো হলো। এটা এতক্ষণ গাছের শাখায় ঝুলছিলো।
আমরা যা কিছু করেছি আমাদের ধর্মের জন্য করেছি। তাদের একজন বললো, আমাদের লোকেরা যে ভাষা ও যে ধরনের ইংগিত বুঝে আমরা তাদেরকে সে ভাষা ও ইংগিতে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি, ওরা যেন নিজেদের ধর্ম না ছাড়ে। ইসলামের প্রতি যেন ঝুঁকে না পড়ে।…..
আপনাদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। এটা দুই ধর্মের মধ্যে শক্রতা। ইসলামের বিস্তৃতি ঘটছে চারদিকে। আমরা তা রোধ করার জন্য বৈধ অবৈধ সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করবো। আমাদের দুজনকে আগুনে ফেলে দিন। আমাদের জ্বলন্ত ছাই থেকে আরো দুজন আত্মত্যগীর জন্ম হবে। যারা আমাদের পথে চলবে। এই গির্জার আগুন সারা উন্দলুসে ছড়িয়ে পড়বে।
***
সূর্যোদয় হচ্ছে। এ সময় হাজিব আবদুল করীম ও সালার রউফ আবদুর রহমানের মহলে পৌঁছলেন। তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো জানবার্য ও খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের লাশ।
হযরত ঈসা (আ) এর কাল্পনিক মূর্তি, ফানুস ও কাঁচযুক্ত কাষ্ঠখণ্ডটিও নিয়ে আসা হলো। আর গ্রেফতার করা দুই খ্রিষ্টানও সঙ্গে ছিলো।
তাদের আসার খবর শাহ উন্দলুস পেয়েছেন। তিনি এখনো শয়ন কক্ষে। সুলতানা তার সঙ্গে রয়েছে।
আবদুর রহমান তাদেরকে ডেকে পাঠালেন।
তারা দুজন সাক্ষাৎ কক্ষে গিয়ে বসলেন। আবদুর রহমান শয়ন কক্ষ থেকে বের হতেই সুলতানা তার খাস খাদেমাকে ডেকে বললো,
যারিয়াবকে গিয়ে বলল, যে অবস্থাতেই থাকুক চলে আসে যেন। আবদুল করীম ও আবদুর রউফ এসেছেন।
আবদুর রহমান সাক্ষাত কক্ষে এলেন। সুলতানাও তার সঙ্গে সঙ্গে কামরায় ঢুকলেন। এখনো তার পরনে নাইটি। দুই কাঁধ ও বাহুমূল উন্মুক্ত। রেশম কোমল ঝলমলে চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো। এ তার প্রকৃত রূপ। এর মধ্যে কোন ধরনের অপ্রাকৃতিক প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। এই নিরাভরণ সাজেই তার থেকে রূপের এক চরম উত্তাপ ঠিকরে পড়ছে।
উন্দলুসের প্রধানমন্ত্রী ও সালার দুজনে দুজনের দিকে তাকালেন। সুলতানাকে দেখে তারা যে মনে মনে ধাক্কা খেলেন সেটাই একে অপরের চোখে পড়ে ফেললেন। তাদের প্রতিক্রিয়া, চিন্তা ভাবনা এক-অভিন্ন।