আলো যেদিকে আছে সেদিকেই রাখো। এখানে সবকিছু দেখা যাচ্ছে।
ওরা হামিদ ও তার সঙ্গীদের দেখে ফেললো। হামিদ রহীম গাজ্জালীদেরকে ডেকে এ দিকে আসতে বললো। তারপর খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
কিন্তু সন্ত্রাসী দল সংখ্যায় বেশি হওয়াতে ওদের তিনজনকে ঘিরে ফেললো। তবে ওদিক থেকে রহীম গাজ্জালীরাও এসে গেলো।
ওদিকে হাজারো মানুষ নক্ষত্রের চমক দেখতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। আর এদিকে নক্ষত্রের চমক দেখানোর কলা-কুশলীরা জীবন-মরণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
***
রাতের শেষ প্রহর। হাজিব আবদুল করীম গভীর ঘুম থেকে হড়বড় করে উঠে বসলেন। তার কামরার দরজায় আওয়াজ হচ্ছে। তিনি দরজা খুলে দেখলেন, তার এক পরিচারক দাঁড়িয়ে আছে। সে হাজিবকে জানালো, বাইরে এক লোক এসেছে। সে এমনই আহত যে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
হাজিব ছুটে বের হয়ে পড়লেন। দারোয়ান ততক্ষণে আহত লোকটিকে এক দিকে শুইয়ে দিয়েছে। সে রহীম গাজ্জালী। ওর আপাদমস্তক রক্তাক্ত। সে যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায় রয়েছে। হাজিব দারোয়ানকে তাড়া দিয়ে বললেন, দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ও শল্য চিকিৎসককে নিয়ে এসো। কিন্তু রহীম গাজ্জালী বাধা দিয়ে বললো,
ডাক্তার বা সার্জন আসার আগ পর্যন্ত আমি জীবিত থাকবো না। রহীম গাজ্জালী কাতরাতে কাতরাতে বললো, আগে আমার কথা শুনুন। এখনো পর্যন্ত যদি আমার কোন সঙ্গী না থাকে তাহলে সবাই মারা গেছে। ওরা নিঃসন্দেহে ভণ্ড, প্রতারক, ভেল্কিবাজধারী।…..
ভেল্কিবাজদের কাউকে হয়তো আমরাও জীবিত রাখিনি। আপনি এখনই সেই পরিত্যক্ত গির্জায় চলে যান। সেখানে আমার সঙ্গীদের লাশ তো পাবেনই এবং সব ভেল্কিবাজির তথ্য উপাত্তও ওখানে পাবেন। আলামত-প্রমাণও হয়তো পেয়ে যাবেন।
থেমে থেমে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলছিলো রহীম গাজ্জালী। তাঁর নিঃশ্বাস ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। ডাক্তার ও সার্জন আসতে আসতে রহীম গাজ্জালীর প্রাণটি তার পরম কর্তব্য পালনরত যখমে যখমে জর্জরিত দেহ থেকে বেরিয়ে গেলো।
হাজিব আবদুল করীম তীব্র বেগে বেরিয়ে আসা কান্না চাপা দেয়ার ব্যর্থ চেস্টা করতে করতে বললেন,
এই শহীদদের রক্ত কি বৃথা যেতে পারে? কখনোই নয়।
শিরা উপশিরায় তার রক্ত টগবগ করতে লাগলো। দাঁতে দাঁত বাড়ি খেতে লাগলো। পরিচারককে প্রায় ধমকে উঠে বললেন, এখনই সালার আবদুর রউফকে ডেকে নিয়ে এসো, সে যে অবস্থাতেই থাকুক সে অবস্থাতেই যেন চলে আসে।
আবদু ররউফের দেউরী দূরে নয়। তিনি চলে এলেন। রহীম গাজ্জালীর লাশ দেখে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হাজিব আবদুল করীম তাকে জানালেন রহীম গাজ্জালী মারা যাওয়ার আগে তাকে কি বলে গেছে।
সালার আবদুর রউফ তখন বিশ পঁচিশ জন সিপাহী ও কমান্ডারদের একটি ইউনিট প্রস্তুত করলেন এবং আবদুল করীম ও তার নেতৃত্বে গোড়সওয়ার হয়ে সবাই পরিত্যক্ত গির্জায় পৌঁছে গেলো। এখনো অন্ধকার থাকায় সঙ্গে করে মশালও নিয়ে গেলো তারা।
গির্জায় ঢুকে তারা দেখলো ভেতরে দুটি বাতি জ্বলছে। কোন মানুষজন নেই। দেয়ালের সঙ্গে কাঠের একটা তখতা পড়ে আছে। এর ওপর হযরত ঈসা (আ) এর অনক বড় কাল্পনিক একটা ছবি। এটাকেই ক্রুশের সঙ্গে ঝুলানো অবস্থায় দেখানো হয়েছিলো। ছবিটি তৈলচিত্র। এ কারণে বেশ চকচকে।
সবাই বাইরে বের হয়ে দেখলো, একটি গাছের নিচে কয়েকটি লাশ পড়ে আছে। এর মধ্যে মুসলমান আত্মত্যাগী ইউনিটের সেই সৈনিকরাও আছে এবং খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরাও।
লাশগুলোকে সনাক্ত করার চেষ্টা করা হলো। একটি লাশ নড়ে উঠলো। এটা মুসলমানের লাশ। সালার আবদুর রউফ তার পাশে বসে পড়া আতহ লোকটিকে তার নাম ধরে ডাকলেন। এক সিপাহীকে বললেন, ওকে উঠাও। ও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
ওর পেট ফেটে গেছে। নিজের সালারকে দেখতে পেয়ে তার চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না। ধীরে ধীরে সে একটি হাত উঠালো এবং ওপরে গাছের দিকে ইংগিত করলো।
আবদুর রউফ জিজ্ঞেস করলেন ওপরে কি দেখেছে? আহত জানবাযের কেবল ঠোঁট দুটো নড়লো। ওপরে উঠানো হাতটি পড়ে গেলো। তার মাথা একদিকে ঢলে পড়লো।
তারপর সবগুলো লাশ দেখা হলো, আর কেউ জীবিত নেই এখানে। গির্জার দিক থেকে কারো ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো।
সিপাহীরা সেদিকে দৌড়ে গেলো। ওরা দেখলো, দুজন লোক সেই কাঠের বড় তখতাটি- যার ওপর ঈসা (আ) এর ছবি ছিলো, উঠিয়ে নিয়ে পালাচ্ছে। সিপাহীদেরকে তাদের পেছনে ছুটে আসতে দেখে দ্রুত পাহাড় থেকে নামতে লাগলো। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দুজনেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো।
গির্জার ভেতর থেকে বোয়া উঠতে দেখা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে চেরাগদানগুলো থেকে উজ্জ্বল আলো বের হতে লাগলো। ছাদটা কড়িকাঠের। আর ভেতরে পুরোনো বেঞ্চ, টেবিল, খাঁটিয়া ছিলো। দ্রুত সেগুলোকে আগুনে গ্রাস করলো। এমন অগ্নিকাণ্ড নেভানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং এর কোন প্রয়োজনও ছিলো না।
***
গ্রেফতার করা দুই খ্রিষ্টানকে জ্বলন্ত গির্জার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। এখন গির্জার দরজা ও জানলাগুরো দিয়েও আগুনের শিখা বের হয়ে আসছ। বারান্দার কাঠের থামগুলোতেও আগুন ধরে গেছে। পুরো গির্জা ভয়ংকর এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।