আমরা সব রকম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। আমরা অবশ্যই যাবো। তাদের মধ্যে একজন বললো।
আমরা কারো কাছ থেকে কোন প্রতিদান চাইবো না।
প্রতিদান আল্লাহর কাছেও চাইবো না।
ছয় আত্মত্যাগী প্রস্তুত হয়ে গেলো।
দুদিন পরই জানা গেলো, আজ রাতে কিছু একটা দেখা যাবে। যারাই ওখানে যাবে তারা যেন ভালো করে পরিস্কার করে গোসল করে পবিত্র হয়ে যায়। মসজিদে সব মুসলমানকে সতর্ক করে দেয়া হলো, কেউ যেন ওখানে না যায়।
তবে সেই ছয়জন মুসলমান যাচ্ছিলো।
তাদের একজন রহীম গাজ্জালী আরেকজন হামিদ আরাবী। তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর চারজন গেরিলা দলের আত্মত্যাগী রয়েছে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ওরা সেখানে পৌঁছে গেলো। দিনের বেলা রহীম ও হামিদ এখানে বকরীচারীর বেশে এসে সবকিছু দেখে গেছে। পাহাড়ের ওপরে গিয়েও ওরা এদিক ওদিক মোটামুটি দেখে নিয়েছে।
সূর্যাস্তের পর আত্মত্যাগী দলটি অন্য দিক দিয়ে পাহাড়ে চড়লো। এই পাহাড়ের ঢাল একটাই নয়। একটি ঢাল শেষ হতেই ওপরে সামান্য কিছু জায়গা ময়দানের মতো সমতল। এখান থেকে অধিক ঢালু ঢাল ওপরে উঠে গেছে। উঁচু ঘাস ও বুনো ঝোঁপ-ঝাড় আড়াল নেয়ার দারুণ ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ওপরের দিকে প্রথম ঢালটি শেষ হতেই সেই পরিত্যক্ত গির্জা। এর ডান দিকে চলে গেলে দেখা যাবে পাহাড়ের নিচের দিকে ঢাল নেমে গেছে। সেখানেই চোরা ও কাদায় থকথকে জায়গায় এবং বদ্ধ পানির বড় সড় একটা চৌবাচ্চাও রয়েছে। যার মধ্যে ছোটখাটো কুমীর আছে।
চোরা ভূমির এক প্রান্তে খাড়া প্রান্তর। যা গাছগাছালি ও ঝোঁপঝাড়ে আচ্ছাদিত। এই প্রান্তরের ওপর দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় শিলা পাথর।
গেরিলা দলের দুজনকে সঙ্গে নিলো হামিদ আরাবী। আর দুজনকে নিলো রহীম গাজ্জালী। ওরা আলাদা হয়ে গেলো। রহীম গাজ্জালীরা পরিত্যক্ত গির্জার কাছে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। হামিদ আরাবী তার সঙ্গীদের নিয়ে সেই গাছগুলোর কাছে চলে গেলো যার ওপর নক্ষত্রের চমক দেখা যায়।
যখন অন্ধকার এত গম্ভীর হয়ে গেলো যে, কারো হাতও নজরে পড়ে না তখন রহীম গাজ্জালীরা গির্জার একেবারে কাছ থেকে কিছু মানুষের নড়াচড়া ও ফিসফিস করে কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেলো। তারপর গির্জার ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। যেটা পেছনের দিকের একটা ভাঙ্গা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো। ভেতর থেকে কয়েকজন লোক বের হলো।
জিনিসগুলো আরেকবার দেখে নাও। কেউ একজন বললো।
যা দরকার সবকিছুই নিয়েছি। তোমরা গাছে গিয়ে ওঠো। লোকজন আসতে শুরু করেছে। আরেকটি গলা শোনা গেলো।
লোকজনের চিন্তা করো না। ওরা তো আর ওপরে উঠতে যাবে না। আরেকজন বললো।
হামিদ আরাবী নক্ষত্র চমকানো গাছের কাছে সতর্ক হয়ে আছে। সে কয়েকটি পায়ের আওয়াজ পেলো। অন্ধকারে দুটি ছায়া মূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। তারপর একজন গাছে চড়তে লাগলো। নিচে দাঁড়ানো লোকটি জিজ্ঞেস করলো,
সেই জায়গাটা মনে আছে তো?
মনে আছে। ভালো করেই মনে আছে।
দুই তিন জন হামিদ আরাবীর একেবারে কাছ ঘেঁষে চলে গেলো। তারা পাহাড়ের ঢালের নিচের প্রান্তরে নেমে গেলো। তারপর সামনের দিকের প্রান্তর থেকে নিচু সুরের কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো।
লোকজন নিচে জমা হতে শুরু করেছে। তাদের শোরগোল স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
***
খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। সামনের দিকের প্রান্তর যেখানে শিলাপাথর দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে, সে জায়গাটা তীব্র আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। হামিদ আরাবী লক্ষ্য করে দেখলো, বড় সাইজের একটা ফানুস জ্বলছে। কিন্তু এর আলো শুধু সামনের দিকে যাচ্ছে। ডানে, বামে, উপরে নিচে যাচ্ছে না।
হামিদ দেখলো, যে লোকটি গাছে চড়েছিলো সে আবার নিচে নেমে আসছে। তার সঙ্গী সেখান থেকে চলে গেছে আগেই। হামিদ নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো। লোকটির নামা শেষ হতেই হামিদ আরাবী বর্শার ফলা লোকটির পাজরে ঠেকিয়ে বললো,
আবার ওপরে যাও। ওপরে যা কিছু রেখে এসেছে সেগুলো নামিয়ে আনো।
কে তুমি? সে অস্বস্তি ভরা গলায় জিজ্ঞেস করলো।
আমি যা বলি তা করো। হামিদ আরাবী বললো।
বর্শা সরাও। আমি ওপরে যাচ্ছি। লোকটি বললো।
সে গাছে চড়তে লাগলো। অন্ধকারে আবছায়া মতোও কিছু দেখা যায় না। লোকটি কি করছে হামিদ সেটা দেখতে পেলো না। লোকটি খঞ্জর বের করে তারপর গাছের দিক থেকে সরে একটু ঘুরেই খঞ্জর দিয়ে আঘাত করলো হামিদকে।
হামিদ নিজেকে বাঁচাতে পারলো না। খঞ্জর তার বাহু কেটে পাজরে গিয়ে লাগলো। তবে পেটে বিদ্ধ হলো না। হামিদ পেছনে সরে গিয়ে বর্শার ফলা আমূল লোকটির পেটে বিদ্ধ করে দিলো।
লোকটি উঁচু আওয়াজে কাউকে ডাকতে ডাকতে পড়ে গেলো।
হামিদ তার লোকদেরকে ডাকলো। হামিদ আছড়ে পাছড়ে সেদিকে ছুটলো যে দিকে তার লোকজন ছিলো এবং এর পাশে আলো জ্বলেছিলো।
গির্জার দিক থেকে কয়েকজন দৌড়ে আসতে লাগলো। তাদের হাতে উদ্যত তলোয়ার। হামিদ আরাবী তার লোকদেরকে লুকিয়ে পড়তে বললো এবং নিজেও ওদের সঙ্গে লুকিয়ে পড়লো।
গির্জা থেকে যারা ছুটে এসেছে তারা সংখ্যায় বেশি। ওরা ওদের আহত সঙ্গীকে দেখতে পেলো। গাছের কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তেই সবাই ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে লাগলো কারা তাকে আহত করেছে।
একজন হামিদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো, হামিদ বসে বসেই তার পাজরে বর্শা ঢুকিয়ে দিলো। লোকটির মুখ দিয়ে এমন আর্তনাদ বেরিয়ে এলো যে, তার সঙ্গীরা এদিকে ছুটে এলো। তাদের মধ্যে একজন উঁচু আওয়াজে বললো,