মসজিদে মসজিদে এ খবর পৌঁছে গেলো। মুসল্লীরা ইমাম ও মাওলানা সাহেবদেরকে জিজ্ঞেস করলো, এ ঘটনা কতটা সত্য?
এটা ভণ্ড খ্রিষ্টানদের বানানো কাহিনী। ধর্মীয় নেতারা তাদের প্রশ্নের উত্তরে বললো, এ ঘটনা সত্য বলে কোন মুসলমান যেন বিশ্বাস না করে। এটা কুফরী। খ্রিষ্টানরা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ অহেতুক, অর্থহীন ও ভিত্তিহীন কাহিনী বানিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে।
মসজিদে মসজিদে এ কথা ঘোষণা করে দেয়া হলো।
ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া সে যুগের একজন বিখ্যাত আলেম ও আইনজ্ঞ। আমীরে উন্দলুস আবদুর রহমান ও প্রধান বিচারপতির ওপর তার তখন একচ্ছত্র প্রভাব। তিনি ফতোয়া দিলেন,
হতে পারে এটা কোন ভেল্কিবাজি; এ ঘটনাকে সত্য বলে মানা এবং এ ঘটনা আবার কখনো ঘটবে তা দেখতে যাওয়া মুসলমানদের জন্য শিরিকী পাপের নামান্তর।
এই ফতোয়া দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, কোন মুসলমান যদি অনুসন্ধানী মন নিয়ে সেদিকে যেতে চায় তারা যেন আর না যায়। কারণ, প্রকৃত মুসলমান যার মধ্যে কুরআন হাদীসের জ্ঞান আছে সে তো অবশ্যই এগুলোকে বিস্বাস করবে না। সে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ভেল্কিবাজি বের করে ফেলবে।
ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়ার ব্যাপারে ইতিহাসে লেখা আছে,
ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া মালিকী মাযহাবের বড় ফকীহ ছিলেন। তবে দরবারী আলেম ছিলেন তিনি। এ কারণে শাহী খান্দানে ও শাহী দরবারে তার ভীষণ প্রভাব পড়ে। কারণ, উন্দলুসে মালিকী মাযহাবেরই প্রসার ছিলো বেশি। সালতানাতের বড় কোন বিষয় তার পরামর্শ ছাড়া গৃহীত হতো না।…..
আর এই প্রভাব ও মর্যাদাকে ইয়াহইয়া রাজনৈতিক উত্থানের কাজে লাগান। প্রশাসনিক ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। আবদুর রহমানের পিতা আলহাকামের যুগে ইয়াহইয়া বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেন এবং আলহাকামকে গদিচ্যুত করতে ব্যর্থ হন। তবে আবদুররহমান তার শাসনামলে তাকে বাবার দরবারের আগের পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।
সালতানাতে উন্দলুসের পতনের ব্যাপারে ইয়াহইয়ার পরবর্তী বংশধররা অতি ঘৃণ্য সব চক্রান্ত চালিয়ে দেশময় বিশৃংখলা সৃষ্টি করে রাখে।
হযরত ঈসা (আ) এর কোন শিষ্য কেন আত্মপ্রকাশ করতে যাবেন? এই ঘটনা কি কোন ভেল্কিবাজি, না এর কোন বাস্তবতা আছে? এসব প্রশ্ন কোন কোন মুসলমানের মনে ঠিকই জাগে। কিন্তু ইহইয়া ও অসচেতন ইমাম ও খতীবদের ফতোয়া তাদের প্রশ্নের সত্যতা যাচাই বাছাই করার ব্যাপারে একেবারেই দমিয়ে রাখে।
সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ এখনো কর্ডোভা ফিরে আসেননি। সালার আবদুর রউফ ও প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম এ ব্যাপারে কিছুটা আলোচনাও করেছেন।
ব্যাপারটা কি এটা আসলে দেখা উচিত। হাজিব বললেন, খ্রিষ্টানদেরকে উস্কে দিতে ও মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে কোন ভেল্কিবাজিরও আশ্রয় নেয়া হতে পারে!
ব্যাপার যাই হোক, শাহ উন্দলুসের সঙ্গে কথা বলার আগে আমাদের নিজেদের ব্যাপারটা দেখে নেয়া উচিত। সালার আবদুর রউফ বললেন।
খ্রিষ্টানরা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে, পুরো শহর, উপ শহর এবং গ্রামেগ ও এটা ছড়িয়ে পড়ছে যে, আজ রাতে ঈসা মসীহের শিষ্যের দেখা মিলতে পারে।
আবদুল করীমের দুজন বেশ তৎপর ও উদ্যোগী গোয়েন্দা আছে। রহীম গাজ্জালী ও হামিদ আরাবী।
আজ রাতে দলে দলে খ্রিষ্টানরা সেই পাহাড়ি প্রান্তরে যাবেই যেখানে নক্ষত্রের চমক দেখা যায়। রহীম গাজ্জালী ও হামিদ আরাবীও ওদের সঙ্গে গেলো।
এত মানুষের ভিড়ে মনে হয় না কোন মুসলমান আছে। কারণ, মসজিদগুলোতে ঘোষণা করে দেয়া হয়, খ্রিষ্টানদের এসব ভেল্কিবাজি দেখা গুনাহ এবং যে মুসলমানই দেখবে তার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
আজকের রাতটিও অন্ধকার। পাহাড়ের নিচে দুই প্রান্তর ভাগের মাঝখানে অন্ধকার আরো গভীর। সবাই ব্যাকুল হয়ে আছে। ধীরে ধীরে প্রার্থনা সঙ্গীতের গু রণ উঠতে লাগলো। পুরো সমাবেশ নীরব হয়ে গেলো।
একটু পরেই পাহাড়ের উঁচু ঢালুতে নক্ষত্র চমকে উঠলো। বহু কণ্ঠ এককণ্ঠী হয়ে পবিত্র গজল গাইতে লাগলো। এই গজল খ্রিষ্টানরা গির্জায় গেয়ে থাকে।
হঠাৎ নক্ষত্রের চমক অদৃশ্য হয়ে গেলো। তারপর এমন এক চমক সবাইকে চমকে দিলো যে, সবার দম বন্ধ হয়ে এলো। এই চমক পরিত্যক্ত গির্জার মিনারের ওপর দেখা গেলো। যেখানে কাঠের ক্রুশ ঝুলানো থাকে। চমক দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দুই আড়াই গজ পরিধির হবে। চমকানো আলোর মধ্যে অনেক বড় ক্রুশ দেখা গেলো এবং এর সঙ্গে ঝুলন্ত হযরত ঈসা (আ)কে দেখা গেলো।
ভিড়ের মধ্যে কান্না ও হেচকি তোলার আওয়াজও শোনা গেলো। আবারো সেই পবিত্র গজলের বহু কণ্ঠী সুর গুঞ্জন করে উঠলো। এবারে আওয়াজে অন্যরকম এক আবেগ ও তরঙ্গ রয়েছে।
দর্শকরা সব হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। সবাই হাত জোড় করে পবিত্র গজল গাইতে লাগলো। রহীম গাজ্জালী ও হামিদ আরাবীর লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। ওরা ফিসফিস করে একে অপরকে বলতে লাগলো, এটা ভেল্কিবাজি হতে পারে না।
ওরা এমন প্রভাবান্বিত হয়ে পড়লো যে, ওরাও খ্রিষ্টানদের মতো হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। যেন অদৃশ্য কোন শক্তি ওদেরকে বসিয়ে দিয়েছে।
ওরা খ্রিষ্টানদের গাওয়া গজল বা পার্থনা সঙ্গীত তো জানে না; কিন্তু তবু চুপ থাকলো না। কালেমায়ে তায়্যিবার জপ শুরু করে দিলো।