উত্থান আর সাফল্য সে জাতির কপালেই চুম্বন করে যারা তাদের পূর্বসুরীদের বিচ্যুতিকে পথের আলোকবর্তিকা বানিয়ে পথ চলে এবং সুখ স্মৃতিকে উদ্দীপনার উৎস ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। কিন্তু দরবারী ঐতিহাসিকরা পরবর্তী প্রজন্মকে সেই ইতিহাসই দিয়েছে, যা বিজয় আর সুকীর্তির কাহিনীতে পূর্ণ।
চারদিকে একটি খবর ছড়িয়ে পড়লো। কর্ডোভা থেকে পাঁচ ছয় মাইল দূরের এক উপত্যকায় হযরত ঈসা (আ) এর এক খাস শিষ্য আত্মপ্রকাশ করেছে। সেখানে এক পাহাড়ি প্রান্তরের ওপর একটি গাছে একটি নক্ষত্র চমকে উঠে। তারপর তার শিষ্যের আওয়াজ শোনা যায়।
সেখানে এক প্রাচীন গির্জার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। গির্জা বেশ উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছিলো। কোন এক যুগে এসে সেটা পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
খ্রিষ্টানরা বলতে শুরু করেছে, এখন সেখানে গির্জার ভেতরে বহু অশরীরি এসে বাসা বেঁধেছে। ভয়ংকর সব কাহিনী শোনানো হতো। কেউ কেউ বলতো, এগুলো অশরীরী নয় বরং হযরত ঈসা (আ) এর যুগের পূণ্যাত্মা।
কিছুদিন ধরে খ্রিষ্টানদের মধ্যে এই গির্জার আলোচনা একটু বেশিই হচ্ছে। অবশেষে একটা খবর ছড়িয়ে পড়লো, ঈসা (আ)-এর এক শিষ্য আত্মপ্রকাশ করেছে। মানুষ তো ভয়ে ওদিকে যেতো না। কিন্তু বিভিন্ন চার্চ ও গির্জায় যখন পাদ্রীরাও এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলো তখন সন্ধ্যার পর লোকজন জটলা। বেঁধে ওদিকে যেতে শুরু করলো।
ওদিকে যখন লোকেরা ভিড় করতে শুরু করলো তখন থেকেই পোড়া গির্জার পাশের একটি গাছে নক্ষত্র চমকে উঠতে লাগলো। সেখানে কিছু স্বেচ্ছাসেবকের মতো লোক দর্শকদেরকে দুই প্রান্তরভাগের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিতো এবং তাদেরকে বলতো, ভয় পাবে না। তারকা চমকে উঠলে ঈসা মসীহকে স্মরণ করবে।
এমনই এক রাতে লোকদেরকে দুই প্রান্তরভাগের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। অন্ধকার রাত। মাঝ রাতের পর চাঁদ উঠবে। লোকজনের সামনে একটি শূন্য প্রান্তর। এর পেছনে উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের ওপর ঘন বৃক্ষ লতায় ছাওয়া। এই বৃক্ষ লতায় গন ঝোঁপের উচ্চতায় সেই গির্জা।
ওপরে যাওয়ার একটি রাস্তা আছে অবশ্য। কিন্তু কত যুগ সে রাস্তা ব্যবহার করা হয় না কে জানে। এজন্য রাস্তাটা ঘাস ও ঝাড়ের মধ্যে মুখ লুকিয়ে আছে। পাহাড়ের মাঝখানে কোন কালে ঝর্ণার পানিতে প্লাবিত কোন ঝিল ছিলো। এখন সেখানে কাদাময় চোরা ভূমি এবং পানিও আছে। আর পানিতে আছে কুমীর। লোকজনের সে পথ না মাড়ানোর এটাও একটা কারণ।
এর আশপাশেও গাছপালায় ভরা একাধিক পাহাড় রয়েছে।
লোকজন পাহাড়ের নিচের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে। এত অন্ধকার যে, কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। ভিড় থেকে লোকজনের কথাবার্থার মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আচমকা সবাই এমন নিঃশব্দ হয়ে গেলো যেন সব মরে গেছে।
সামনের পাহাড়ের ঢালের একটি গাছের ওপর একটি নক্ষত্র চমকাতে দেখা গেছে। আকাশের নক্ষত্রের মতো সেটা ঝলমল ঝলমল করছে।
আজো কোথাও হযরত ঈসা (আ) বা তার কোন শিষ্যের আত্মপ্রকাশের গুজব শোনা গেলে কোন এক গাছে বিদ্যুৎচমকের মতো নক্ষত্র চমকানোর কথা। অবশ্যই শোনা যাবে।
এনময় গির্জার দিক থেকে কয়েকজন মানুষের সুরেলা আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। কোন প্রার্থনার সঙ্গীত গাইছে তারা। নিঃস্তব্ধ রাতে এই সঙ্গীত সমবেত মানুষের ওপর জাদুর মতো ছেয়ে গেলো। সবাই যার যার বুকে ডান ও বাম হাত রেখে ক্রুশের আকৃতি বানিয়ে এই সঙ্গীত গাইতে লাগলো।
নক্ষত্র স্থির নয়। এদিক ওদিক হেলছে দুলছে। এর আলো সামান্য কিছু জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে।
ক্রুশের পূজারীরা! এক গম্ভীর-ভারী গলার আওয়াজ শোন গেলো, ক্রুশ ও ঈসা মাসীহের অনুসারীরা! আমি পয়গাম নিয়ে এসেছি। আমি আসতেই থাকবো। ধ্বংস তোমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। সেটা তোমরা থামাও। সেটা থামানোর শক্তি তোমাদের আছে।….
ঈসা মাসীহের হাত ও পায়ের কাটা যখমে মুসলমানদের আযানের শব্দ নুনের ছিটা দিচ্ছে। হযরত ঈসা (আ) কুষ্ঠরোগীদের আরোগ্য দান করতেন। কিন্তু তিনি কুষ্ঠরোগী বানাতেও পারেন। যারা খ্রিষ্টধর্ম ছেড়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে তারা স্বধর্মে ফিরে এসো। না হয় সবাই কুষ্ঠ রোগী হয়ে যাবে।
নক্ষত্র অস্তমিত হয়ে গেলো। আবার সব অন্ধকারে ডুবে গেলো। লোকজনের নিঃশব্দতা আরো গম্ভীর হয়ে গেলো। তারপর ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো। যেটা বাড়তে বাড়তে গুঞ্জনের রূপ নিয়ে শোরগোলে পরিণত হলো। গির্জার দিকে থেকে আবার আওয়াজ ভেসে এলো,
এখন তোমরা চলে যাও। নিজেদের কাজ কর্মে সতর্ক থেকো, …..আগামীকাল এসো। হয়তো তিনি আবার আত্মপ্রকাশ করতে পারেন।
লোকজন ভয়ে আতংকে নিজেদের বাড়ির পথ ধরলো।
***
গুটি কয়েক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার মতো ঘটনা নয় এটি। সেটা তো এক পশ্চাদপদ যুগ। কোথাও শিক্ষার আলো নেই। সাধারণ মানুষ রহস্যজনক ও বিচিত্র সব ঘটনাকে দিনের সূর্যের চেয়ে সত্য মনে করতো। এসব দারুন উপভোগ করতো। যখন পরস্পরকে কোন ঘটনা শোনাতো তখন নিজেদের পক্ষ থেকেও কিছু কাহিনী যোগ করে লোকজনকে শোনাতো।
হযরত ঈসা (আ) এর কোন শিষ্যের আত্মপ্রকাশ এক নক্ষত্রের মাধ্যমে; এমন অলৌকিক ঘটনা যে কেউ দেখতে চাইবে। এর মধ্যে অনেক মুসলমানও রাতে সেই পরিত্যক্ত গির্জা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।