তারপর এই সন্তানরাই এই মিশনকে অগ্রগামী করবে এবং এমন এক সময় আসবে যে, তোমাদের শত্রু জাতি এমনভাবে কালের হাওয়ায় উড়ে যাবে যেমন প্রখর রৌদ্রে ভেজা শিশির উড়ে যায়। হ্যাঁ, আমরা আপনাদেরকে অধঃপতনের পথে নামিয়ে দিয়েছি।
আমাদের সেনাবাহিনী সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি? উবাইদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি আমাদের সেনাবাহিনীকেও অধঃপতনের পথে নিয়ে যেতে পারবে? ওদেরকে পরাজিত করতে পারবে?
যে জাতির বাদশাহ বা শাসকরা নিজেদের সিংহাসন আর রাজমুকুটের হেফাজতের জন্য স্বজাতিকে ধোকা দিতে পারে এবং শত্রুকে বন্ধু মনে করে। গানবাদ্য আর যৌন-বিলাসকে নিজেদের ওপর ছায়ার মতো সওয়ার করে রাখে,নিজের বিবেক বুদ্ধিকে কোন সুন্দরী নারী বা গায়কের হাতে বন্ধক রাখে…..
সে জাতির সেনাবাহিনী যত শক্তিশালী আর দুর্দান্ত হোক না কেন ওরা এক সময় বেকার হয়ে যায়। আপনাদের সেনাবাহিনীর অবস্থাও তাই হবে। যখন শাসক ও সেনাবাহিনীর চিন্তা-ভাবনা বিপরীতমুখী হয়ে যায় তখন স্বজাতি জীবিত থাকতে পারে না। জীবিত থাকলেও তাদের ভাগ্যলিপিতে কারো গোলামি লিখে দেয়া হয়।
সালারে আলা! সেনা ইউনিটের কমান্ডার উবাইদুল্লাহকে বললো, এ লোক ভাড়াটে খুনি বা সন্ত্রাসী নয়। এতো সন্ত্রাসী দলের বড় নেতা মনে হচ্ছে। একে জীবিত রাখা মানে ভয়ংকর এক জঙ্গি গ্রুপকে জীবিত রাখা। ওকে আপনি হত্যা করছেন না কেন?
না, সালারে আলার দৃষ্টি তখন সিলওয়াসের চেহারায় নিবদ্ধ এবং তার ঠোঁটে মুচকি হাসি, তিনি বললেন, ওকে হত্যা করা আমার ওপর ওয়াজিব নয়। আমি এমন শত্রুকে সম্মান করি।
আর আমিও আপনাকে শ্রদ্ধা করি। সিলওয়াস উবাইদুল্লাহকে বলে কমান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বললো, হত্যা করতে হলে নিজেদের বাদশাহকে হত্যা করো আমার বন্ধু। আর তাকে নিজেদের বাদশাহ বানাও যে নিজের ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে মত্ত নয়।
একটু পর সিলওয়াস ঘোড়ায় চড়ে একদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো।
***
এতে তো কোন সন্দেহ নেই, সালতানাতে উন্দলুসকে অনেক আগেই চক্রান্তকারী খ্রিষ্টানরা অধঃপতনের পথে নিয়ে গেছে। পুরো খ্রিষ্টান জাতির মধ্যে এক ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে।
ইউগেলিস, ইলওয়ারের মতো নেতা ও পাদ্রীরা এমন সুক্ষ্ম বিষয়ের ওপর খ্রিষ্টান জাতিকে উস্কে দিলো, যার মধ্যে মুসলিম সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে এবং লড়াই এড়িয়ে যাওয়ার চমৎকার কৌশল রয়েছে।
তাদের আসল হামলা ছিলো ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতির ওপর এবং মুসলমানদের মন-মানসের ওপর। যাতে ভোগ, বিলাস, বিনোদন আর প্রেম ভালোবাসার সহজ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
একদিকে রইলেন উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহর মতো সালার, যিনি ইসলামের জন্য রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। আর অন্যদিকে শাহী মহলের কোন নারী কণ্ঠের অট্টহাসি বা কোন গায়কের মায়াভরা সুর-তরঙ্গ।
আবদুর রহমানের দরবারে নারী, নর্তকী, গায়কদেরই প্রাধান্য ছিলো না, কবিয়াল গোষ্ঠিরও বড় দখল ছিলো। আবদুর রহমান কাব্য কবিতার প্রতিও দারুণ ভক্ত ছিলেন। কিন্তু সেসব কবি ও গীতিকারদেরই দরবার পর্যন্ত যাতায়াত ছিলো যারা দরবারের উপদেষ্টা ও আমীর উমারাদের পছন্দের হতো। সর্ব দরবারী কবিরাই পরবর্তীতে উন্দলুসে ইসলামের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাদশাহর সামান্য আপত্তি আছে এমন কোন কথাই এরা এদের কাব্যে রাখতো স্থান দিতো না। এভাবে ওরা বাদশাহদেরকে শব্দের আফিম খাইয়ে মাতাল করে রাখতো।
তারীখুল উম্মত এর উদ্ধৃতি এরকম,
বনী উমাইয়ার ওযীর, নাযীর, আমীর উমারাদের নির্বাচনে ব্যক্তিগত পছন্দ ও সুপারিশই সবচেয়ে বড় নীতি ছিলো। বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যের কোন অভাব ছিলো না তাদের। যথেষ্ট পরিমাণেই ছিলো, কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ খুব কমই হতো। ওযীর ও আমীর ততক্ষণেই ওযীর আমীর থাকতো যতক্ষণ তারা বাদশাহর দৃষ্টিতে মনোনীত থাকতো।
যার ওপর থেকে বাদশাহর দৃষ্টি সরে যেতো তার সব পদমর্যাদা, সব অর্জন মাটিতে মিশে যেতো। এমন অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি ও চরম স্বার্থপরতাই অধিকাংশ যোগ্য ও প্রতিভাবান নেতৃত্বকে অংকুরেই নষ্ট করে দেয়।…..
এসব শাসকদের আসল লক্ষ্য যেহেতু ছিলো নিজেদের ঘরানায় ও খান্দানে পূর্ণ সালতানাত কায়েম করা, এজন্য বিভিন্ন শক্তিধর গোত্র ও ব্যক্তির ওপর নিজের প্রাধান্য ও প্রভাব বিস্তার করে রাখা খুবই জরুরি ছিলো।
আর তাদেরকে এভাবে হাতের মুঠোয় রাখতে গিয়ে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ডালা সবসময় উন্মুক্ত রাখতো। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তারা কাড়ি কাড়ি সম্পদ খরচ করতো। আমীর-উমারা ও সরদাররা ছাড়াও খতীব, কবি, গীতিকার, গায়ক, সুন্দরী নারীদের পেছনে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করা হতো। আর যারা বাদশাহদের তোষামোদ করতো, প্রশংসা-গুণকীর্তন করতো তারা তো হয়ে উঠতো একেকজন সম্পদের মনুষ্য পর্বত।
উন্দলুসের ইতিহাস সেসব দরবারী কবি-সাহিত্যিকরাই লিখেছেন যারা তাদের কালের শাসকদের শিল্প ও ছন্দের ভাষায় চরম আত্মতুষ্টিতে মগ্ন রাখতো। তাদের সেসব লেখাই তো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে পৌঁছেছে। যার মধ্যে শাসক শ্রেণীর গুণকীর্তন আর তাদের অবদানের কথাই উঠে এসেছে বেশি, তাদের অযোগ্যতা, ভুল-ত্রুটি, ক্ষমতার লোভ, অপকর্মের কথা তারা জেনে শুনেই চেপে গেছে।