কামরার চারটি দরজা। একটি দরজা খোলা। দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। এ সময় পেছন থেকে মৃদু পায়ের আওয়াজ পেলেন। তিনি পেছনে ফিরে তাকালেন।
ততক্ষণে তিনি ছয়জন দীর্ঘদেহী শক্তিশালী মানুষর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন। সবার হাতে উদ্যত বর্শা। তাদের চোখে ক্রোধ আর ঘৃণা।
এরা যে খ্রিষ্টান এতে কোন সন্দেহ রইলো না উবাইদুল্লাহর এবং তিনি যে অনেক বড় ভুলের মধ্যে পা দিয়েছেন সেটা দেরিতে হলেও তিক্তভাবে অনুভব করলেন। এই দুই ঘোড়সওয়ারের কথায় এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি।
তোমরা কি চাও? তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমরা যা চেয়েছি তা পেয়ে গেছি। ছয়জনের একজন বললো।
সিপাহসালার! তোমার দুই মুহাফিজকে আমরা খতম করে দিয়েছি। দেউরী সংলগ্ন দরজা থেকে আওয়াজ এলো।
উবাইদুল্লাহ সেদিকে তাকালেন। তার দুই মুহাফিজ ঘোড়সওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের হাতে তরোয়ার ছিলো। দুজনের তলোয়ারই রক্তে লাল। ওদেরকে তাহলে ওদের তলোয়ার দিয়েই হত্যা করা হয়েছে।
তুমি এখন আমাদের কয়েদী একজন বললো, ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে হত্যা করবো না।
তোমার ভাগ্যের ফয়সালা করবেন শাহে ফ্রান্স লুই।
আর আমরা তোমাকে বলবো তুমি সে রক্তের কি মূল্য দেবে যা তুমি বিদ্রোহ দমনের নামে খ্রিষ্টানদের শরীর থেকে ঝরিয়েছে। তাদের একজন বললো।
এর মূল্য কি তাও শাহে লুই বলবেন। দীর্ঘকায় আরেকজন বলরো। তোমার তলোয়ারটি আমার হাতে হাওলা করে দাও। একজন এগিয়ে আসতে আসতে বললো।
সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ তার তলোয়ারের বাট শক্ত করে ধরে বললেন,
প্রাণ দিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হবো না; কিন্তু তলোয়ার দেবো না। তোমরা আটজন আর আমি একলা। তবুও লড়তে ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের বর্শার ফলাগুলো যখন আমার দেহে ঢুকে যাবে এবং আমার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাবে তখন তোমরা তলোয়ার নিয়ে নিয়ো।
বাস্তবায় ফিরে এসো উবাইদুল্লাহ। তাদের মধ্যে নেতা গোছের একজন বললো, আমরা তোমাকে হত্যা করতে পারবো না। জীবিত নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু লড়াই করে আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করলে মারা যেতে পারো।
আমি এজন্য প্রস্তুত। আমার লাশই শাহ লুইয়ের কাছে নিয়ে যেতে পারবে।
আমরা ক্রুশের পূজারী। আরেকজন বললো, ডাকো তোমাদের রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে; তোমাকে আমাদের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে। …..আমরা তোমার কাছে তলোয়ার চেয়েছি।
তলোয়ার আমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই দেবো। উবাইদুল্লাহ কঠিন গলায় বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত অনুসারী দুশমনের হুমকিতে তলোয়ার ছেড়ে দেয় না।
এ সময় হঠাৎ বাইরে অনেকগুলো ঘোড়ার খুরধ্বনি শোনা গেলো। কাছে। এসে শব্দ থেমেও গেলো।
দেখো তো বাইরে কে? সাবধানে দেখবে। নেতা গোছের খ্রিষ্টানটি বললো।
তাদের একজন পা টিপে টিপে বাইরে বের হলো এবং শরীর লুকিয়ে উঁকি মেরে বাইরে তাকালো এবং একইভাবে ভেতরে চলে এলো।
ওকে মেরে ফেলে এখান থেকে বেরিয়ে যাও। লোকটি তাগাদা দিলো সবাইকে।
উবাইদুল্লাহ বুঝে গেলেন বাইরে তার লোকজনই এসেছে। ওরা তাঁরই সেনাদলের একটি ইউনিট।
এতে প্রায় বিশজন ঘোড়সওয়ার রয়েছে। এরা আশপাশের এলাকায় টহল দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো। এই পোড়া গির্জার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে বাইরে চারটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। দলে কমান্ডার দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর দেখলো দুটি লাশ পড়ে আছে।
ঘোড়া থেকে নেমে কাছে গিয়েই চিনতে পারলো সিপাহসালারের মুহাফিজ ছিলো ওরা। বাইরে যে ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে এর সওয়ার যে ভেতরে রয়েছে এটাও নিশ্চিত হয়ে গেলো তারা।
দলীয় কমান্ডারকে যে লোকটি বাইরে উঁকি দিয়ে সেনা ইউনিটকে দেখে ভিতরে গিয়ে বলেছিলো উবাইদুল্লাহকে মেরে ফেলল। তার পিছু পিছু মুসলিম কমান্ডারও ভেতরে ঢুকে পড়লো। সবাই কমান্ডারের দিকে তাকালো।
এই সুযোগে উবাইদুল্লাহ তলোয়ার বের করে তার একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীর ঘাড়ে সজোরে আঘাত করলেন। একটুর জন্য মাথাটি ধড় থেকে আলাদা হলো না।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিৎকার করে কমান্ডারকে বললেন, সবাইকে ভেতরে ডাকো।
কমান্ডারও চিৎকার করে তার লোকদের ভেতরে আসতে বললো। কয়েকজন সন্ত্রাসী বাইরের দিকে ছুট দিলো। আর দুজন উবাইদুল্লাহর ওপর বর্শা চালালো।
যারা বাইরের দিকে দৌড়াতে লাগলো তাদেরকে পথেই মুসলিম সৈনিকরা পথরোধ করে দাঁড়ালো এবং এরা পালাতে চেষ্টা করলো না। তারা লড়াই শুরু করে দিলো।
উবাইদুল্লাহ ওদিকে দুই বাধার বিরুদ্ধে একাই লড়তে লাগলেন। বর্শা তো বেশ লম্বা। এজন্য উবাইদুল্লাহর তলোয়ার বর্শাধারী পর্যন্ত পৌঁছছিলো না।
তার সৈন্যরা বাইরে রক্তক্ষয়ী লড়াই লড়ছিলো।
উবাইদুল্লাহ তলোয়ারের আঘাতে আঘাতে একটি বর্শা ভেঙ্গে ফেললেন। এর মধ্যেই দুজন সৈন্য ভেতরে এসে গেলো। ওরা একজন বর্শাধারীকে নিমিষেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। আরেকজনকে জীবিত গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন উবাইদুল্লাহ।
উবাইদুল্লাহ বাইরে বের হয়ে দেখলেন, ক্রুশের পূজারীরা জাহান্নামে চলে গেছে। তার সৈন্যদেরও তিনজন শহীদ হয়ে গেছে। সন্দেহ নেই, এই খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী দলটি বেশ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে।