প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ পাম্পালুনার সফল অভিযান শেষ করে ফিরে আসার সময়ও ছোট ছোট খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী দলগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে দিতে আসছিলেন। তিনি কয়েকটি ছোট ছোট ইউনিটও তৈরি করে নেন, যারা আচমকা আশেপাশের এলাকায়, ঘন বনজঙ্গলে কিংবা উঁচু নিচু উপত্যকায় হানা দিতে এবং শক্রর আস্তানা আবিস্কার করে তা গুঁড়িয়ে দিতো।
সিপাহসালার উবাইদুল্লাহর সেনাদল এক ময়দানে তাঁবু ফেলেছে। এর আশেপাশে পাহাড়ি প্রান্তর ও বনজঙ্গলে ভরা। সন্ধ্যা এখনো নামেনি। এসময় দুজন ঘোড়সওয়ার এলো। দেখে ওদেরকে সাধারণ মুসাফির বলেই মনে হচ্ছিলো। দুজনের অবস্থাই ধূলো মলিন।
ওরা জানালো, ওরা খ্রিষ্টান ছিলো। ইসলাম গ্রহণ করেছে। সিপাহসালারের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চায়। বলতে লাগলো, বিশেষ এক গোপন কথা আছে, সেটা একমাত্র সিপাহসালারকেই বলা যাবে। ওদের দেহ তল্লাশী করা হলো। না, ওদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেলো না। তারপর তাদেরকে সিপাহসালারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।
হতে পারে এটা আমাদের কেবল সন্দেহই, দুজনের একজন সিপাহসালার উবাইদুল্লাহকে বললো, কিন্তু আমরা যা দেখেছি সেটা আপনার পর্যন্ত পৌচানো নিজেদের একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি। আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। এর অর্থ হলো, ইসলামের প্রতি আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা আছে। ইসলামকে যোগ্য মনে করেছি বলেই আমরা এর জন্য খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করেছি।
ওরা এ ধরনের গুরুগম্ভীর ও দীর্ঘ ভূমিকা ছাড়ার পর বললো; এক প্রান্তর দিয়ে ওরা যাচ্ছিলো। একটি পোড়া বাড়িতে চারপাঁচজন মহিলাকে ঢুকতে দেখলো ওরা। মহিলাদের ওপর ওদের কিছুটা সন্দেহ হলো। কারণ, ওদের পোশাক এ এলাকার লোকদের মতো নয় এবং এই পোড়া ও নির্জন এলাকায় ওরা একা সফর করতে পারে না।
তারা জানালো যে, তারা দুজন পোড়া দালানের ভেতর চলে গেলো। এটা প্রাচীন কোন গির্জার ধ্বংসাবশেষ। ওরা দুজন মহিলাদেরকে জিজ্ঞেস করলো ওরা কারা? কোত্থেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছে?
ওরা বললো, ওরা নওমুসলিম। মুসলিম সেনাদল থেকে একটু দূরে দূরে থেকে ওরা এই সেনাদলের সঙ্গে যাচ্ছে।
আমরা এই সেনাদলের প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে চাই, মহিলারা এই লোক দুজনকে বলেছিলো, কিন্তু আমরা তো নারী। এজন্য সৈনিকদের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছি। আমাদের কাছে কিছু গোপন তথ্য আছে সেটা শুধু সালারকেই বলতে চাই। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে না চাইলে আমরা ফিরে যাবো। তিনি কষ্ট করে এখানে আসলে তাকে সব কথা বলে দেবো।
উবাইদুল্লাহর ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো।
আমাকে তোমরা বেকুব বানাতে এসেছো? উবাইদুল্লাহ বললেন।
এত বড় দুঃসাহস কি আমরা দেখাতে পারি? দুজনের একজন বললো, ওরা পুরুষ হলে ওদেরকে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম। মহিলাদেরকে তো আমাদের সঙ্গে আসতে বাধ্য করতে পারি না আমরা। তবুও বলেছিলাম আমাদের সঙ্গে আসতে। কিন্তু ওরা মানলো না। ওদের মধ্যে দুজন তো কাঁদতে শুরু করলো। জানি না, ওরা কি বলতে চায়। মেয়েদেরকে আপনার কিসের ভয়? তবে আপনি যেতে না চাইলে সেটা আপনার মর্জি। আমরা মুসাফির। আমাদের পথে আমরা নেমে যাবো।
ওরা এমনভাবে কথা বললো উবাইদুল্লাহর সঙ্গে যে, তিনি ওদের সঙ্গে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তার সঙ্গে নিলেন মাত্র দুজন মুহাফিজ। এসব এলাকায় তিনি তার ফৌজের মাধ্যমে এমন আতংক ছড়িয়ে দিয়েছেন যে, তাকে কেউ ধোকা দেবে এমন দুঃসাহস করাও অসম্ভব ব্যাপার।
সেই পোড়া গির্জা এখান থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে প্রান্তরভাগের মধ্যে। দুই ঘোড়সওয়ার সবার আগে, তার পেছনে উবাইদুল্লাহর ঘোড়া, এর পেছনে মুহাফিজদের ঘোড়া।
পোড়া গির্জার কাছে যেতেই ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগলো। সামনের দুই ঘোড়সওয়ার দাঁড়িয়ে পড়লো।
আর সামনে যাবেন না সিপাহসালার! মুহাফিজদের একজন উবাইদুল্লাহকে বললো, এদেরকে মানুষ মনে হয় না। কোন জিনটিন হবে। কারণ, ওদের তো কান্নার কোন কথা ছিলো না। এরা তো আমাদের সঙ্গে এমন কিছু বলেনি যে, এরা মজলুম নারী।
ভেতর থেকে ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যেতে লাগলো, বাঁচাও, ওই জালিমদের হাত থেকে বাঁচাও।
***
দুই ঘোড়সওয়ার তলোয়ার বের করে ঘোড়া থেকে নেমেই গির্জার দিকে ছুটে গেলো। উবাইদুল্লাহও ঘোড়া থেকে নেমে সেদিকে ছুটলেন। মুহাফিজরাও তার পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো।
সহসাই লোক দুজন বেরিয়ে এলো। ওরা হাসছিলো। নারী চিৎকার এখন আর নেই। ওরা উবাইদুল্লাহ ও মুহাফিজ দুজনকে বাইরে দাঁড় করিয়ে বললো, তেমন কোন ব্যাপার নয়। কয়েকটি ঘোড়ার আওয়াজ শুনে ভেবেছে, ওদেরকে বুঝি সৈন্যরা পাকড়াও করতে এসেছে। আমাদেরকে দেখে শান্ত হয়ে গেলো।
আপনার মুহাফিজরা বাইরে থাকুক। শুধু আপনি ভেতরে আসুন। ওরা শুধু আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চায়। আর কারো সঙ্গে নয়।
মুহাফিজ দুজন বাইরে রয়ে গেলো। উবাইদুল্লাহ ভেতরে চলে গেলেন। এটা একটা দেউরীর মতো দালান। ছাদ বেশ নিচু। বেশ ছমছমে পরিবেশ। দুর্গন্ধও নাকে আসছে। উবাইদুল্লাহ সামনের একটি কামরায় গিয়ে ঢুকলেন। কোন মহিলাকে দেখতে পেলেন না। ততক্ষণে তিনি তার তলোয়ারও কোষবদ্ধ করে কোমরে ঝুলিয়ে ফেলেছেন।