কিন্তু আজ আমি এই সত্যকে লুকোতে পারছি না যে, জানি না কাল থেকে কখন আমার হৃদয় জুড়ে ওর ভালোবাসায় ভরে উঠেছে। মনে হচ্ছে ও নয়, আমিই ওর দিকে চুম্বকের মতো লেপ্টে যাচ্ছি।………
এখন আমি বুঝতে পারছি ওর মধ্যে কোন জাদু আছে যা দিয়ে সে আবদুর রহমানের মতো দূরদর্শী, জ্ঞানী ও রণকুশলী বাদশাহকে নিজের শিষ্য বানিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ও তো পুরো এক জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি পর্যন্ত বদলে ফেলেছে।
প্রেম ভালোবাসা পাপ নয় সুলতানা! ইউগেলিস বড় বিচক্ষণ কণ্ঠে বললো, কিন্তু যাদের ব্যক্তি মহিমার উপলব্ধি আছে, সে তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও ব্যক্তিত্বকে সামান্য প্রেম ভালোবাসার জন্য বিসর্জন দেয় না। তোমাকে সম্রাজ্ঞী বানাচ্ছি সুলতানা! তোমার মধ্যে আমি সম্রাজ্ঞীর এক মহিমা দেখেছি। কিন্তু সে পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে তোমাকে এক নাটকের ভূমিকায় থাকতে হবে।…..
এর মধ্যে অন্যতম একটি নাটক এটাও যে, যারিয়াবকে তোমার প্রেমের শেকলে বেঁধে রাখবে। ওর ওপর তোমার যৌবনের জাদু ছেয়ে রাখো। ওকে ওর আসল অবস্থায় জাগতে দিয়ো না। ওকে রূপ ও প্রেমের নেশায় মাতাল থাকতে দাও।…..।
আমি জানতে পেরেছি, ও, আমাদের অনক বড় বিশাল কাজ করে দিয়েছে। কিছু আরব দেখেছি আমি, যারা কথা বলে আরবী ভাষায়, কিন্তু পোষাক আশাক ও চুল রাখার স্টাইল এবং চালচলন সব আমাদের মতো। আমাদের সংস্কৃতিই ওদের সংস্কৃতি হয়ে গেছে।
তুমি তাহলে অনেক কম দেখেছো। সুলতানা বললো, আমরা এর চেয়ে আরো অনেক বেশি সফল হয়েছি এখানে তোমাদের তুলনায়।
চলো, ও আমাদের অপেক্ষায় আছে, ওর কোন সন্দেহ যেন না হয়। তোমাকে আমি আরেকবার বলছি, নিজেকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখো। যারিয়াবের মতো এমন সক্ষম পুরুষকে তোমার অবশ্যই ভালো লাগা উচিত। ওর মধ্যে দারুণ আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু ওকে চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় রাখো।
ইউগেলিস সুলতানার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো। যেন ও তাকে আশীর্বাদ করছে।
যারিয়াব যেখানে একা বসে রয়েছে সেখানে পৌঁছে গেলো ওরা।
***
যারিয়াব! আমার এত সময় নেই যে, লম্বা চওড়া কথা শুনবো এবং শোনাতে বসে যাবো এখানে। ইউগেলিস বললো ব্যস্ত গলায়, আমি জানি তোমাকে যে কাজ দিয়েছি সেটা বেশ সাফল্যের সঙ্গেই করে যাচ্ছে। আমার উদ্দেশ্য তুমি নিশ্চয় বুঝে গেছো। আমি শাসন ক্ষমতার লোভী নই। আর এটাও বলবো না নিজের ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে তুমি খ্রিষ্টান বনে যাও।…..
আমার চোখে ধর্ম কোন তাৎপর্যের বিষয় নয়। আমি মানবতার মুক্তির দাবীদার। তোমরা দুটি মানব-মানবী। যদি সুলতানা এত সুন্দরী না হতো, আর তুমিও এত উচ্চ পর্যায়ের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক না হতে তাহলে এখন আবদুর রহমানের দরবারে তোমাদের যে বিশাল অবস্থান তা কি তোমরা হাসিল করতে পারতে?
আবদুর রহমান যে এত বড় এক রাজ্যের শাসক হয়ে বসে আছে, তুমি কি ওকে এর যোগ্য মনে করো? শাসক হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে আসলে তোমার। তোমাকে সেই অবস্থান নিজেকেই অর্জন করতে হবে।
তুমি যে বলেছো আবদুর রহমান এত বড় রাজ্য শাসন করার যোগ্য নন এটা একেবারেই ভুল বলেছো, যারিয়াব ইউগেলিসকে বললো, তার শাসন ক্ষমতার যোগ্যতার কথা আশেপাশের খ্রিষ্টান বাদশাহরাও স্বীকার করেন। তুমি কি এটা ভুলে গেছো, তার বাবা আলহাকাম যখন আমীরে উন্দলুস ছিলেন সালতানাতের প্রশাসনিক সব ক্ষমতা আবদুর রহমানের হাতে ছিলো? আবদুর রহমান না থাকলে আলহাকাম উন্দলুসকে কবে ধ্বংসের অতলে ডুবিয়ে দিতেন।…..
এটা আমার ও সুলতানার যে অনেক বড় কৃতিত্ব সেটা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে। আমরাই তার উদ্যমী মানসিক শক্তি ও অসামান্য প্রশাসনিক যোগ্যতাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। এ লোকের মধ্যে যদি নারীপূজা ও গানবাদ্যের প্রতি এমন উন্মত্ততা না থাকতো তাহলে আজ উন্দলুসে কোন খ্রিষ্টানের সহস হতো না যে, সে বিদ্রোহের কথা বলে,…..।
আজ যদি কেউ ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় তাহলে তোমাদের পাতা ষড়যন্ত্রের জাল কয়েক দিনেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু এটা আমার একক কৃতিতু যে, আমি এখানকার নকশা, জীবন যাপন অন্যরকমভাবে বদলে দিয়েছি। আমি শাহী খান্দান ও এর সঙ্গে যারা উঠাবসা করে তাদের মধ্যে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও জীবন যাপন রীতির প্রচলন করে দিয়েছি। তুমি যেমন বলেছো, তোমার দৃষ্টিতে ধর্ম কোন অর্থবোধক বিষয় নয়, আমার কাছেও ধর্ম অর্থহীন জিনিস।
যারিয়াব বাস্তবেই অর্থহীন মনে করতো ধর্মবিশ্বাসকে। কিন্তু ইউগেলিসের আপাদমস্তক খ্রিষ্ট ধর্মে ডুবন্ত ছিলো। যারিয়াবের মতো অসম্ভব দূরদর্শী ও বিচক্ষণ লোকও বুঝতে পারলো না, ইউগেলিস তাকে যা বলেছে নিজের ব্যাপারে সেটা একেবারেই মিথ্যা এবং থোকা।
যারিয়াব তো বলতো, আবদু ররহমানের বড় দুর্বলতা হলো, তিনি নারী ও গানবাদ্য বলতে বেহুশ। কিন্তু সে নিজে বুঝতে পারেনি, সুলতানা নামের এক ভয়ংকর সুন্দরি নারীকে তার মন-মস্তিষ্কে সওয়ার করে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে তার ধর্ম ও দেশের শত্রুদের দাবার অর্থ খুঁটিতে পরিণত হয়েছে।
সে রাতে ওরা ওদের মিশন নিয়ে অনেক কথা বললো। ওদের সবার মিশনই তো এক। তবে ইউগেলিস সতর্ক লোক। সে যারিয়াব ও সুলতানার কাছে অনেক কিছুই চেপে গেলো।