মানবতার শত্রু কুফরের অশুভ ঝড় ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে। তারপরও আমাদের রক্তমাখা এই দীপ্ত শিখার সলতে প্রজ্জ্বলিত রাখা যাবে শুধু ত্যাগের মাধ্যমে। হয়তো এমন এক প্রজন্ম আসবে যারা এই টিমটিমে প্রদীপটি নিজেদের উষ্ণ রক্ত ধারায় এমন বিপুল আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলবে যেমন আমাদের প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোনালী যুগে স্বর্ণাভা হয়ে জ্বলতো।
সালার আবদুর রউফের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার চোখ পবিত্র আভায় পূর্ণ হয়ে গেলো। এ আসলে তার জাগ্রত আত্মার বিভা, যা তার চেহারায় খেলে গিয়েছে। তিনি তো স্বাধীনতার ত্যাগী সৈনিক। পদমর্যাদা ও ক্ষমতার জন্য উন্মাদ নন।
***
যারিয়াবের চেহারায়ও আজকাল এ ধরনের উজ্জলতা দেখা যায়। এমনিই তো সে দারুন সুদর্শন। কিন্তু সুলতানাকে দেখলেই অন্যরকম এক আভা তার চোখে মুখে ঝলকে উঠে।
সুলতানা যখনই তার জায়গীরে যেতো যারিয়াবকেও নিয়ে যেতো। কয়েক দিন পর পরই আবদুর রহমানের কাছে এসে অজুহাত দাঁড় করাতো মহলের বদ্ধ পরিবেশে দম আটকে আসছে। একটু মুক্ত আবহাওয়ায় ঘুরে আসতে চায়। আবদুর রহমান নিষেধ করার সাহস পেতেন না।
প্রথম প্রথম তো সুলতানা যারিয়াবকে লুকিয়ে ছাপিয়ে নিয়ে যেতো। পরবর্তীতে আবদুর রহমানকে এই বলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতো, সে যারিয়াবকে একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে।
চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর নরম চাদর। ফুলের মনকাড়া সৌরভ। মখমলের মতো বিছানো ঘাস। এর মধ্যে দুজন বসে আছে। নিঃশব্দ রাত।
এই নিঃশব্দ-মায়াময় পরিবেশে যারিয়াবের গিটারের মৃদু লয়ের আওয়াজ এক কল্পজগত সৃষ্টি করেছে। গিটার যারিয়াবের সবচেয়ে প্রিয় রাগ-সঙ্গীত। গিটার যন্ত্রে যারিয়াব পঞ্চতারের সংযোগনী এনে বাদ্যযন্ত্রে এক বিপ্লব ঘটিয়েছে। বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞ যারিয়াবকে গিটারযন্ত্রের আবিষ্কারকও বলতে শুরু করে।
যারিয়াব গিটারের তারে শৈল্পিক হাতের কাজ দিয়ে দারুণ মনোমুগ্ধকর সুর তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে। এ ব্যাপারে তার জুড়ি নেই কোথাও। সুলতানাও এই সুর তরঙ্গে পাগলপারা হয়ে যেতো। গিটারের সুরতরঙ্গ আর যারিয়াবের সুক্ষ্ম গলার গান সুলতানার একেবারে অন্তরমূলে আঘাত করছিলো আজ। কিন্তু সুলতানা নিজের মধ্যে এমন বিচলতা অনুভব করছিলো যেন বাদ্যযন্ত্রের এই তরঙ্গাভিঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো।
তুমি আমার কাছে থাকলে মনে হয় আমার সব ব্যক্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে। যারিয়াব সুলতানাকে বললো, আমি যেন তোমার অস্তিত্বের মধ্যে হারিয়ে যাই।
সে সুলতানার বাহু ধরে তাকে টেনে কাছে আনতে গেলো, কিন্তু সুলতানা তার কাছে না এসে দূরে সরে গেলো। যারিয়াব মৃদু হেসে বললো,
তুমি তো জানো, আমি কতটা তৃষ্ণার্ত। দূরে সরে যেয়ো না সুলতানা?
খোদা তোমাকে অনেক জ্ঞান বুদ্ধি, বিচক্ষণতা দান করেছেন যারিয়াব! সুলতানা একরোখা গলায় বললো, কিন্তু ভালোবাসার মর্মভেদ তুমি বুঝতে পারবে না…..তুমি কি এই পাওয়ার অতৃপ্তিতে এই তৃষ্ণায় দারুণ ভালোলাগাকেই অনুভব করছো না?
আর তুমি কি মিলনের স্বাদ সম্পর্কে জানো? না…. তুমি জানো না। যারিয়াব বললো।
মিলনের ব্যাকুলতায় আর ছটফটানিতে যে স্বাদ আর উপভোগ্যতা রয়েছে সেটা কিন্তু মিলনের মধ্যে নেই। সুলতানা বললো, তুমি জানো না, শাহে উন্দলুসের চোখে আমি কখনো আমার প্রতি প্রেম দেখিনি। তার প্রেম ভালোবাসা আমার দেহের সঙ্গে। তার এই ভালোবাসার বয়স ততদিন যতদিন আমার সৌন্দর্য আর যৌবনের সঞ্জীবতার বয়স থাকরে। যেদিন সে আমার প্রতি আর আকর্ষণ বোধ করবে না সেদিন আমি হেরেমে নিক্ষেপিত এক বঞ্চিত নারী হয়ে যাবো।…..।
আমি চাই না, তুমি আমার দেহের স্বাদ উপভোগ করো। তাহলে তুমিও একদিন বিতৃষ্ণ হয়ে পড়বে। এখনো আমি এক মায়াময় রহস্য। এই রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে তোমার প্রেমের ব্যাকুলতা মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে। তুমি যদি আমাকে তোমার আনন্দ বিনোদনের খেলনা বানাতে চাও তাহলে আমি তোমাকে আমার এক গ্রাহক মনে করবো। যারিয়াব! আমাকে তোমার পূজা করতে দাও।
যারিয়াব মুখে মিটি মিটি হাসি ধরে রেখেই তার হাত পেছনে নিয়ে গেলো। এসব কথা সুলতানা যারিয়াবকে এই প্রথমই নয়, আরো কয়েকবার বলেছে। সে যারিয়াবের মধ্যে তৃষ্ণার এই ব্যাকুলতা খুব ভেবে চিন্তেই উস্কে দিচ্ছে। এমন অস্থিরতা আবদুর রহমানের মধ্যেও সে জাগিয়ে তুলেছিলো।
আবদুর রহমান তো মুদ্দসসিরা, জারিয়া ও শিক্ষার জন্য পাগলপ্রায় ছিলেন। সুলতানা ওদেরকে দিয়ে আবদুর রহমানকে ভোগমত্ত জীবনে ডুবিয়ে রাখতো। আর নিজে তার বাহুবেষ্টনীতে থেকেও মাঝেমধ্যে দূরে থাকতো।
***
ঘোড়ার ছুটে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মনে হয় ইউগেলিস! যারিয়াব বললো।
হ্যাঁ, সেই হবে। তুমি এখানে বসো। আমি ওকে নিয়ে আসছি। সুলতানা বলে সেখান থেকে চলে গেলো।
সুলতানা ইউগেলিসের ঘোড়াটি এক সহিসকে দিয়ে তাকে একটু দূরে নিয়ে গেলো। তাকে জানালো যারিয়াবও এখানে আছে।
আমি তো এক সমস্যায় পড়েছি ইউগেলিস! সুলতানা বললো, এটা তো তুমি জানো, যারিয়াব আমার প্রেমে কেমন দেওয়ানা হয়ে আছে। আমিও তাকে এটা বুঝাচ্ছি যে, ওকে আমি এর চেয়ে বেশি ভালোবাসি এবং ওর প্রতি আরো দেওয়ানা আমি। দেখো ইউগেলিস! আমি তোমার কথা মতো ওর জন্য দারুণ মনকাড়া মরীচিকা হয়ে এ অবস্থা করেছি ওর। আর সেও আমার পেছন পেছন ছুটে আসছে।……