কি আমীর উমারা, কি সাধারণ মানুষ যারিয়াবের প্রভাব সবার ওপরেই ছিলো। বাদশাহ তো যেন তার আশেক ছিলেন। যারা সরাসরি বাদশাহর কাছে যেতে পারতো না, তাদের জন্য একমাত্র ভরসা ছিলো যারিয়াবই।
এর কারণে যারিয়াব সব আলেম, কামেল, পন্ডিত, মন্ত্রী, সচিব হাকিম, শাহজাদা, শাহজাদী এবং দরবারীদের অতি প্রিয় এবং গুরু বনে গিয়েছিলো। আবদুর রহমান তো তাকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টার পদমর্যাদা দান করেন।…..
যারিয়াব নিজে কারো প্রতি দুর্বল ছিলো না। একমাত্র মালিকায়ে তব সুলতানা ছাড়া। সুলতানা যখন প্রথমে তার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করলো তখন দেখা গেলো, যারিয়ার আগে থেকেই সুলতানার প্রতি আসক্ত হয়ে আছে। তার মাথা নত হলে তা হতো একমাত্র সুলতানার সামনে। তার এই অন্ধ প্রেম-ভালোবাসার পেছনে ছিলো ইসলামের ভয়ংকর দুশমন ইউগেলিসের হাত। যারিয়াব সেটা বুঝতে পারেনি। অবশ্য একসময় সুলতানাও ধীরে ধীরে যারিয়াবের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠে।…..
আবদুর রহমান কখনো অনুভবই করেননি, যে সুলতানা তার সবচেয়ে প্রিয় রমণী, সে যারিয়াবকেই ভালোবাসে। তার সঙ্গে শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে।
সুলতানার এই ভালোবাসার পেছনে যে মুসলমানদের অনেক বড় শত্রু ইউগেলিসের হাত রয়েছে, যারিয়াব সেটা বুঝতে পারেনি।
***
আবদুর রহমানের রাজ দরবারে প্রচলিত সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিনোদন এমনকি স্থাপত্যত্ত নির্মাণশৈলীতে ও যারিয়ার আবিস্কৃত বিপ্লবের ছোঁয়া তখন এসে গিয়েছিলো।
আবদুর রহমানের সালরে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ তখন পাম্পালুনা অঞ্চলে খ্রিষ্টান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছিলেন।
ইতিমধ্যে উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ দুই ফ্রান্সীয় কাউন্টকে চরমভাবে পরাজিত কেরেছেন। যারা উন্দলুসের পাম্পালুনা অঞ্চলে হামলা করে লুটপাট চালিয়েছিলো।
তিনি তার কাজ শেষ করে ফিরতি পথ ধরলেন। কিন্তু ফেরার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করলেন না। ফিরতি পথের ডান বাম ও আশেপাশের এলাকার অবস্থা দেখভাল করতে করতে আসছিলেন।
এসব এলাকার অধিকাংশই পাহাড়ি ও বন্য। উবাইদুল্লাহর জানা আছে, এসব এলাকার জায়গায় জায়গায় খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের আস্তানা রয়েছে। যেখানেই তার সন্দেহ হলো সেখানেই তিনি ওদের অড়াখানা আবিস্কার করে করে সমূলে ধ্বংস করে দিতে লাগলেন।
এসব ছোটখাটো অপারেশনে থাকায় রাজধানীতে ফেরাটা তার বেশষ ধীরগতির ছিলো।
প্রধান সেনাপতি যে এখনো ফিরে আসছেন না রাজধানী কর্ডোভায়, এ নিয়ে যেন আবদুর রহমানের কোন মাথা ব্যথাই ছিলো না। তবে প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম ও এক সালার আবদুর রউফের পেরেশানী-দুশ্চিন্তা দিন দিন বাড়তেই থাকে। অবশ্য তারা পত্রদূত পাঠিয়ে খবরাখবর নিতে থাকেন।
আমার তো আশংকা হচ্ছে, আমীর আবদুর রহমান এই সালতানাতকে ধ্বংস না করে ক্ষান্ত হবেন না। একদিন সালার আবদুর রউফ হাজিব আবদুল করীমকে বললেন, এর কি কোনই প্রতিকার নেই?
আমরা আমীর আবদুর রহমানকে হত্যা করাতে পারি। আবদুল করীম বললেন, আমরা যারিয়াব ও সুলতানাকেও হত্যা করাতে পারি। কিন্তু ওতে অবশেষে লাভটা কি হবে? আবদুর রহমানের খান্দানের কেউ একজন তার সিংহাসনে বসে যাবে। তারপর তো এ রেওয়াজ দাঁড়িয়ে যাবে, হত্যা করো আর গদি দখল করো। ধীরে ধীরে খেলাফত দুর্বল দুর্বল হতে ভেঙ্গে যাবে এবং একদিন এর নাম নিশানাও মিটে যাবে। তাই আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।
আমি তো আমীরে উন্দলুস আবদুর রহমানকে একটা কথা বলতে চাই, সালার আবদুর রউফ ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে বললেন, তাকে বলবো, রাজত্ব করো আর ইসলামের নাম বেঁচা ছেড়ে দাও। তিনি তো আমাদেরকে থোকাই দিচ্ছেন। কারুকার্যময় সুন্দর সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করাচ্ছেন। কুরআন শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলছেন। এটা কি পাপ নয়?
এখন আমি বুঝতে পারছি। সালতানাতে উন্দলুস শুধু দুর্বলই নয় একে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হাজিব আবদুল করীম বললেনু, শাসকরা যখন সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক ও তোষামোদকারীদের মায়াবী ভাষার জালে আটকে পড়েন তখন সালতানাতের খুঁটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একেবারে শেকড় থেকে
দুর্বল শত্রুরাও ধীরে ধীরে বড় যুদ্ধশক্তিতে পরিণত হয়। আর আবদুর রহমানের মতো শাসকরা নিজেদের চরম শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার হীন পথ-পদ্ধতি বের করতে থাকে। কারণ, তাদের সিংহাসন ও ক্ষমতার নিরাপত্তা এর মধ্যেই তারা নিহিত দেখতে পায় যে, দুশমনকে শক্তিশালীর মর্যাদা দিয়ে তাদেরকে বলবে, এসো আমরা বন্ধু হয়ে যাই। আর পরস্পরের বিরুদ্ধে আমরা তলোয়ার উঠাবো না।…..
আবদুর রউফ! তোমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যাও। পরবর্তী প্রজন্ম তোমাদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। হতে পারে তোমাদের রেখে যাওয়া অবদান, অক্লান্ত পরিশ্রম, রক্তাক্ত পদক্ষেপ, ঈমানদীপ্ত জযবা তাদের জন্য পথের আলোকবর্তিকা হবে।
আজ যদি তোমরা যারিয়াবের আমদানী করা সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিতে ডুবে যাও তাহলে তোমরা তোমাদের সন্তান ও তাদের আত্মজদের প্রতি অনেক বড় জুলুম করবে;…..।
ওদের পর্যন্ত যখন কালের এই পরিণতির অশুভতা পৌঁছবে তখন ইসলাম কেবল একটা নামসর্বস্ব বিষয় হয়ে যাবে। মানুষ যাকে ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া কোন ধর্ম বা কিছু লোকের ধর্মবিশ্বাস বলা ছাড়া আর কিছু বলতে চাইবে না। এজন্যই আমাদেরকে ইসলামের এই প্রদীপ্ত দীপশিখাকে আলোকিত রাখতে হবে। সেটা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে হলেও প্রদীপ্ত রাখতে হবে …..