বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র মূলতঃ পরাজিত খ্রিষ্টানরাই করছিলো। আর তাদেরকে মদদ যোগাতে থাকে পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান অঙ্গরাজ্যগুলো। কিন্তু এ কারণে ওদেরকে গালমন্দ করা উচিত হবে না। ওরা তো ঘোষণাই দিয়েছে, ইউরোপ থেকে ইসলামকে ঝেটিয়ে বিদায় করেই তারা দম নেবে।
তারা একে পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে। এভাবেই উন্দলুস অদৃশ্য এক যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হলো।
এ পরিপ্রেক্ষিতে উন্দলুসের আমীর উমারাদের প্রথম ফরজ কর্তব্য তো ছিলো, ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করা। ইসলামের প্রচার প্রসারে সর্বাধিক মনোযোগ ঢেলে দেয়া। কিন্তু তারা তাদের নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলো। পরিণামে কি হলো?
একজন শাসক মরতেই উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে যেতো। গদিতে তো বসতো একজন। আর তার আপন সন্তান, চাচাতো ভাই বোন, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা তার নিচ থেকে মাটি সরানোর ষড়যন্ত্রে শরীক হয়ে যেতো।
এই সুযোগে উন্দলুসের দুশমনরা সীমান্ত এলাকায় বিশৃংখল ও অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করে নেয়। দেশের ভেতরে বিদ্রোহ দানা বাঁধা শুরু করে। কিন্তু দরবারী তোষামোদকারীরা তাদের বাদশাহকে রিপোর্ট দেয়, সবকিছু ঠিক আছে। এভাবে তার চোখ, কান ও বিবেক বুদ্ধির ওপর পর্দা ফেলে রাখে। তোমাদকারীরা।
পুরস্কারস্বরূপ এসব তোষামোদকারীরা অনেকে শাসকদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। কথার জাদুতে তারা শাসকদেরকে বশ করে রাখে। শাসকরা তাদেরকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেয়। যেখানে বসার নূন্যতম যোগ্যতাও তাদের থাকে না। কারণ, দেশের প্রতি আন্তরিকতা, চিন্তা ভাবনার গভীরতা, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এসব কিছুই তাদের মধ্যে। দেখা যায় না।
মুখে মধু, অন্তরে বিষ এই যোগ্যতাই তাদের পদ প্রাপ্তির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা হতো।
ইতিহাস লেখকনরা মোটা দাগের জিনিসগুলো দিয়েই ইতিহাস রচনা করেছে। পূর্বপুরুষরা যারা তোষামোদকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তারা পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি এই জুলুমও করে গেছে যে, তাদের রচিত ইতিহাসে এমন কোন কথা, এমন কোন তথ্য বা ঘটনা খুব কমই লিপিবদ্ধ হতে দিয়েছে যা শাসকদের বিরুদ্ধে যায়।
উন্দলুসের কিছুটা সঠিক ইতিহাস লাতিন ভাষায় পাওয়া যায়। ইউরোপীয় কিছু ঐতিহাসিকও সেসব খ্রিষ্টানদের উল্লেখ করতে গিয়ে সঠিক ইতিহাস রচনার চেষ্টা করেছেন যারা উন্দলুসে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে সবসময় চক্রান্ত করে গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে তারা উন্দলুসের সেসব বীর সেনানীর ইতিহাসও লিপিব্ধ করেছে যাদের আত্মত্যাগে উন্দলুসে ইসলামী শাসন ছিলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী জানা যায়, উন্দলুসের শাসকদের বিরুদ্ধে অতি সংগোপনে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের আগুন সর্বপ্রথম সবচেয়ে বেশি ছড়ায় আবদুর রহমান ছানী ইবনে আলহাকাম এর শাসনামলে।
আবদুর রহমান তার দরবারে সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ যাকে রাখেন সে হলো সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়ক যারিয়াব। ইতিহাস তার ব্যাপারে লিখেছে,
যারিয়াব তার গানবাদ্য যখন কর্ডোভার দরবার কক্ষে উপস্থাপনা করলো তখন সেখানে শুধু তার ভক্তই ছিলো না, সমালোকচকও ছিলো। কিন্তু তাদের বিস্ময়ের সীমা রইলো না, যখন তারা দেখলো, যারিয়াব আবদুর রহমানের মন মানসে স্থায়ী আসন গেড়ে ফেলেছে এবং আবদুর রহমান তার একান্ত শিষ্য বনে গেছেন। …..
গান বাদ্য ছাড়াও মুখের ভাষায় জাদু ও মধু প্রয়োগে যারিয়াবের সমতুল্য সে যুগে কেউ ছিলো না।……
তার সৃজনশীল শক্তি ও অসাধারণ যোগ্যতা শুধু সঙ্গীত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো না। পোশাক আশাকের ক্ষেত্রেও তার উদ্ভাবনী রুচি ছিলো। নানান ধরনের বিভিন্ন রঙের কাপড়ে বিচিত্র কারুকাজ করা এবং মেয়েদের জন্য এমন সুক্ষ্ম রেশমী কাপড়ের উদ্ভাবন করে যারিয়াব যে, সেগুলো পড়লে শরীরের ভাঁজগুলোও দেখা যেতো। সে মুসলিম সমাজের বিনোদনের জন্য অনেক কিছুই আবিষ্কার করে। যা কেবল অমুসলিমদেরই সংস্কৃতির অংশ ছিলো।…..
উন্দলুসের মুসলিম সোসাইটিতে আরবদের কৃষ্টি কালচারের প্রাধান্য ছিলো। কিন্তু যারিয়াব তাদের মধ্যে নতুন কালচারের বিপ্লব ঘটায়। আরবদের মতো মুসলমানরা মাথায় লম্বা চুল ও মুখে লম্বা দাড়ি রাখতো। যারিয়াব এমন লাইফ ষ্টাইলের প্রচলন ঘটালো যে, লোকে চুল কেটে ইউরোপীয়ানদের মতো টেরিকাট রাখতে লাগলো এবং দাড়িও ছাটতে শুরু করলো।
এ ছাড়াও নারীদের জন্য বহু ধরনের ফ্যাশনের প্রচলন করে যারিয়াব। এর মধ্যে কিছু ছিলো সরাসরি উলঙ্গপনার নামান্তর।
***
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যারিয়াব ছেয়ে যায়। এমনকি মানুষের বাসস্থান, ঘরবাড়ি, দালানকোঠাতেও আধুনিকতার ছাপ এনে দেয় যারিয়াব। বিচিত্র রকমের সুগন্ধিও আবিষ্কার করে। তার কথাবার্তা, বিভিন্ন উক্তি জনশ্রুতি ও জনরোলে পরিণত হয়।
তার মন-মস্তিষ্ক সব সময় নতুন পরিকল্পনা, নতুন আবিষ্কারের চিন্তায় বিভোর থাকে। এসব কারণে বহু মানুষ তার একেবারে শিষ্য হয়ে যায়। কেউ বলতো, ওর প্রতি কুযুর্গ, মনীষী এবং আধ্যাত্মিক পুরুষদের আশীর্বাদ আছে। যারা স্বপ্নযোগে তাকে এই বিচিত্র আবিস্কারের উপাদান দিয়ে গেছেন।…..
কেউ কেউ বলে, তার অনুগত জিন বা অশরীরি কেউ আছে। যাদের কাছ থেকে সে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। আর না হয় বাদশাহ এমন উন্মাদের মতো কারো গোলাম হতেন না…..