আমি তোমার এই জযবা ও আবেগকে অবশ্যই মূল্যায়ন করি ইউগেলিস! শাহ লুই বললেন, কিন্তু তুমি সম্ভবতঃ জানো না, আরবের এই মুসলমানদেরকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা অতি কঠিন কাজ।
কঠিন এজন্য যে, মুসলমানরা ধর্মীয় আবেগকে উন্মাদনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে লড়াই করে। শাহ লুই বলতে লাগলেন, তাদের প্রবল বিশ্বাস হলো, তারা একমাত্র খোদার সন্তুষ্টির জন্য অমুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তারা বলে, লড়াইয়ের সময় খোদা তাদের সঙ্গে থাকেন।
ইউগেলিস! তুমি যদি উন্দুলুসে মুসলমানদের আগমনের কথা শুনে না থাকো তাহলে আমার কাছ থেকে শুনে নাও। ওদের সংখ্যা ছিল মাত্র সাত হাজার। উন্দুলুসের উপকূলে পৌঁছে ওরা তাদের সবগুলো নৌযান জ্বালিয়ে দেয়। যাতে ফিরে যাওয়ার কল্পনাও ওদের মাথায় না আসে।..
তুমি তোমার ফৌজ বা সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে পারবে, কিন্তু তাদের মধ্যে এই চিন্তা-চেতনা ও জযবা সৃষ্টি করতে পারবে না যে, তারা মন থেকে ঘরে ফিরে যাওয়ার চিন্তা দূর করে দেবে। পিছু না হটার মানসিকতা গড়ে তোলা অত সহজ কাজ নয়। এই জযবা ও অদম্য স্পৃহার কারণেই মুসলমানরা যেখানেই হামলা করেছে বিজয় লাভ করেছে। তাদের ওপর যারা হামলা করেছে তারা পিছু হটেছে।….
আজ এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে, মুসলমানরা শুধু সামনে অগ্রসরই হচ্ছে। পিছু হটেনি। ফ্রান্সও তাদের হাত থেকে নিরাপদ নয় সম্ভবতঃ এটা তুমি জানো না। তারা সুযোগ পেলে ফ্রান্সে হামলা করে এই দেশটিও তাদের সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেবে।
তাহলে কি ওদের বিরুদ্ধে আপনি কিছুই করবেন না? আমি তো ওদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে দেয়ার চিন্তা করছি। আপনাকে শুরুতেই বলেছি, আমি এক গোপন সংগঠন ও জঙ্গি দল গড়ে তুলেছি। যারা উন্দুলুসের সাধারণ মানুষকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং হুকুমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত করছে।
আমাদের অতিথি বন্ধু ইউগেলিস কি জানেন না এ পর্যন্ত কত হাজার হাজার খ্রিষ্টান মুসলমান হয়ে গেছে? শাহ লুই এর প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রে কেনিথ বললেন, ওরা পাক্কা মুসলমান হয়ে গেছে। ওরা সেই ধর্ম-শাসিত শাসকদের বিরুদ্ধে কখনো বিদ্রোহ করতে রাজি হবে না যাদেরকে তারা মন-প্রাণ দিয়ে মেনে নিয়েছে।
ইউগেলিসের ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। তার দৃষ্টি সভার সবার ওপর দিয়ে ঘুরে এলো। সবার নজরও তার দিকে। সে তার ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে বললো,
হ্যাঁ, এটা আমি জানি। কিন্তু আপনার এটা জানা নেই যে, এই খ্রিষ্টান যারা তাদের ধর্ম বদল করেছে তারা কিন্তু আমারও অনুসারী। ওরা নিঃসন্দেহে মুসলমান হয়েছে, মসজিদে গিয়ে নামাযও পড়ে। সময়মতো রোজাও রাখে। কিন্তু তাদের অন্তর থেকে এখনো ক্রুশের ভালোবাসা বের হয়নি। ওরা ভেতর ভেতর তেমন খ্রিষ্টানই রয়ে গেছে যেমন আগে ছিলো।………..
এর কারণ হলো, আরবের কিছু মুসলমান যারা সুশিক্ষিত নয়, তারা এসব নওমুসলিমকে খাটো চোখে দেখে এবং তাদেরকে নিজেদের প্রজা মনে করে। তাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করে না। এরই ফায়দা এখন আমরা পাচ্ছি।
এই নওমুসলিমরা মুসলমানদের জন্য থোকা হয়ে আছে। ওরা ওদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামায পড়ছে এবং তাদের আড়ালে গিয়ে তাদেরই শিকড় কাটার পরিকল্পনা আঁটছে। ওদের একজন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে কোন খ্রিষ্টীয় বাদশাহর সাহায্যেরও প্রয়োজন। সাহায্য বলতে আমি বুঝাচ্ছি সেনা। সাহায্য।
ইউগেলিস এ বিষয়ে আরো বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বললো। এতে ফ্রান্সের বাদশাহ শাহ লুই নিশ্চিত হয়ে গেলেন এ লোক মুসলমানদের গুপ্তচর নয়। এলোক সে উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছে, যা শাহ লুই এর অন্তরে লালিত হচ্ছে এবং তাকে তা অস্থির করে তুলছে। সেটা হলো, স্পেন থেকে মুসলমানদেরকে উৎখাত করা হবে। অন্যথায় ইসলাম পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে এবং খ্রিষ্টজগতেও একসময় ইসলাম বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
ইউগেলিস! শাহ লুই এবার আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, নিজেকে নিজে তুমি একা ভেবো না। মুসলমানদের খোলা ময়দানে পরাজিত করা সম্ভব নয় আমি যে একথা বলছিলাম এর অর্থ এই নয় যে, আমি কিছুই করবো না। আমি গোথাকমার্চের বাদশাহ ব্রেন হার্টকে এজন্যই এখানে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে ডেকেছি।…..
আমাদেরকে মুসলমানদের শিকড় মাটির নিচে গিয়ে কাটতে হবে। এখন উন্দুলুসের বাদশাহ আবদুর রহমান ছানী। আমি জেনে নিয়েছি সে কেমন স্বভাবের এবং তার চালচরিত্র কেমন! সে আক্ষরিক অর্থেই কঠিন যোদ্ধা। লড়তেও জানে। লড়াতেও জানে। নিজের ধর্মের প্রতি ভালোবাসা তার মনে প্রাণে জুড়ে রয়েছে।…..
সঙ্গে সঙ্গে সে উন্দুলুসের সীমানা বিস্তৃত করার পরিকল্পনাও করছে। জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোসকতায় তার ভূমিকা অনন্য। তার বাবা আবদুর রহমান আলহাকাম (প্রথম) উন্দলুসের ক্ষতি কম করে যাননি। ভোগবিলাস প্রিয় ছিলেন তিনি। তোষামোদকারীদের দুহাত ভরে এনআম ও নজরানা দিতেন। নিজেকে সারা দুনিয়ার বাদশাহ বলে দাবি করতেন।
কিন্তু আবদুর রহমান ছানী তার বাপের মতো নয়। তার বাপ মুসলমানদের এই সালতানাত ও ইসলামের যে ক্ষতি করে গিয়েছেন আবদুর রহমান এর ক্ষতিপূরণ করছে। তবে তার এসব গুণ ও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে একটি দুর্বলতাও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সেটা হলো, সে গান-বাদ্য সংগীত ও নারীর প্রতি সীমাহীন আসক্ত। যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরে রাখতে তার এই দুর্বলতাকে আরো স্থায়ী করে তুলতে হবে আমাদের।….