না, আমীরে মুহতারাম? হাজিব আবদুল করীম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলরেন, দুশমন এটা কখনো দেখে না যে, তাদের বিরুদ্ধে যে ফৌজ আসছে তারা কি তাদেরকে বাদশাহকে বিদায়ী সালাম জানিয়ে এসেছে কি না। এখন সেলামী প্রথা পালনের সময় না আমীরে উন্দলুস! এর চেয়ে অনেক বড় দায়িত্ব হলো, কর্তব্য পালনের ডাকে সাড়া দেয়া।
তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো, রাষ্ট্রীয় সব নিয়ম কানুন ও প্রথা-প্রচলন উঠে যাবে? আবদু রহমান বিরক্ত গলায় বললেন।
মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নিয়মনীতি আমাদেরকে দিয়েছেন তাই বহাল থাকবে। আর মানব রচিত সব নিয়মকানুন, প্রথা-প্রচলন রহিত হয়ে যাবে। আমরা দাবী করবো ইসলামী সালতানাতের আর তাতে চলবে সব অনৈসলামিক কার্যকলাপ তো চলতে দেয়া যাবে না। হাজিব আবদুল করীম এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।
আবদুর রহমান যেন কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেন। তারপর হাজিবের সঙ্গে খ্রিষ্টানদের বিদ্রোহ বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন।
সীমান্ত এলাকায় পাম্পালুনা নামক একটা জায়গা আছে। কিছু দিন আগে এর ওপর ফ্রান্সীয় দুই কাউন্ট হামলা করে এবং শহর ও গ্রামে লুটপাট চালায়। তারা অনেক মুসলমানকে বন্দি করে ওদের সঙ্গে নিয়ে যায়। তারপর তাদের সঙ্গে জন্তু-জানোয়ারের মতো আচরণ করে। গাধার মতো খাটায়।
উবাইদুল্লাহ অল্প কয়েক দিনেই পাম্পালুনা পৌঁছে গেলেন। সেখানকার স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে সীমান্তের বাইরের এলাকাগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। তিনি জানতে পারলেন, সীমান্ত এলাকার সঙ্গে একেবারে লাগোয়া অবস্থায় খ্রিস্টানরা কেল্লা গড়ে তুলেছে। এই কেল্লার পরিবেষ্টন যে মুসলমানদের প্রতিহত করার জন্য এটা বুঝতে সময় লাগলো না উবাইদুল্লাহর।
উবাইদুল্লাহ আবদুর রহমানের কাছ থেকে এ অনুমতি নেননি যে, তিনি সীমান্ত ছেড়ে এর বাইরে গিয়ে শত্রু সীমানায় হামলা চালাবেন। প্রয়োজন মনে করলে ওখানে গিয়ে হামলা চালাবেন এ মর্মে কোন অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি উবাইদুল্লাহ।
উবাইদুল্লাহ যখন তার ফৌজ নিয়ে সীমান্ত এলাকা পাড়ি দিলেন তখন মাঝ রাত পার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে স্থানীয় গাইড ছিলো। সে তাদের শত্রু সীমান্তের সবচেয়ে বড় কেল্লার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। চলার গতি ত্ৰুত থাকায় রাতের শেষ প্রহরে সেখানে পৌঁছে গেলো মুসলিম সেনাবাহিন।
সেখানে পৌঁছেই কেল্লা অবরোধ করে ফেললো উবাইদুল্লাহর সেনাদল। অবরোধ কাজ পূর্ণ হতেই মিনজানীক দ্বারা কেল্লার ভেতর পাথর নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের জ্বলন্ত তীরও কেল্লার ভেতর ছুঁড়তে শুরু করলো। মিনজানীক ও জ্বলন্ত তীর আরবদের এমন হাতিয়ার ছিলো যা শত্রুপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতোই, সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে আতংকও ছড়িয়ে দিতো।
অপরাধী খ্রিষ্টানরা কেল্লার ওপর থেকে বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। কিন্তু উবাইদুল্লাহর সৈন্যরা যেমন চাঙ্গা মনোবলে উদ্দীপ্ত ছিলো, কমান্ডাররাও ছিলো ক্রোধের আগুনে উত্তপ্ত। ওরা তীর বৃষ্টির মধ্যেই কেল্লার ফটকের দিকে দৌড়ে যেতো এবং তীর খেয়ে খেয়ে আহত হতো। এভাবে চললো কিছুক্ষণ।
তারপর একবার কয়েকজন দুঃসাহসী সৈনিক তীর বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফটকের দিকে ছুটে গেলো এবং দশ বারটা কুড়াল দিয়ে দরজার ওপর আঘাত করতে করতে দরজা ভেঙ্গে ফেললো। তার পর বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলো।
মুসলিম সেনারা বাঁধভাঙ্গা জলোচ্ছাসের মতো ভেঙ্গে ফেলা ফটক দিয়ে ভিতরে চলে গেলো। সামনের কয়েকজন অবশ্য শত্রুর ছোঁড়া তীর আর বর্শার। আঘাতে শহীদ হয়ে গেলো। কিন্তু পুরো মুসলিম সেনাদল তাদেরকে টপকে খুনী খ্রিষ্টানদের ওপর পাহাড়ের মতো ভেঙ্গে পড়লো।
এরপর যা হলো তা হলো, উবাইদুল্লাহ ফৌজ যে লড়াইয়ে যোগ দিলো তা ছিলো এক কথায় ইসলাম ও উন্দলুসের দুশমনদের পাইকারি দরে হত্যা।
মুসলিম কয়েদিরা এই কেল্লাতেই ছিলো। তাদের পায়ে লোহার কড়া দিয়ে রেখেছিলো নরপিশাচের দল। রাতে এই কড়ার সঙ্গে শিকল বেঁধে দেয়া হতো। তাদেরকে পশুর খোয়াড়ে রাখতো। তাদের সবাইকে মুক্ত করা হলো।
তারপর অন্যান্য কেল্লাগুলোও এভাবে অবরুদ্ধ করা হলো। অবশ্য সে কেল্লাগুলো ছোট ছোট ছিলো। একে একে কেল্লাগুলো বালুর স্তূপের মতো মাটিতে ধ্বসে গেলো।
উবাইদুল্লাহ যখন তার সেনাদের নিয়ে ওখান থেকে ফিরতি পথ ধরলো, তখন দুশমনদের বসতিগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিলো এবং কেল্লাগুলো থেকে ধোয়া উঠছিলো।
***
উন্দলুসের পবিত্র মাটি বিদ্রোহ আর ষড়যন্ত্রের এক কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠলো। একের পর এক শাসক দাফন হতে লাগলো আর তাদের স্থলে খলীফার পক্ষ থেকে নতুন নতুন শাসক নিযুক্ত হতে লাগলো।
ওদিকে খেলাফতের গদিতে নতুন নতুন খলীফার পালাবদল ঘটতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোতে চক্রান্ত আর বিদ্রোহ দ্বিগুণ আকারে দানা বাঁধতে শুরু করলো।
উন্দলুসের শাসকরা তো মূলতঃ খলীফার পক্ষ থেকে আমীর হিসেবে নিযুক্ত হতেন। কিন্তু তারা নিজেদরকে বাদশাহ বলতে লাগলেন। ইসলামের মহান পয়গাম তারা সিংহাসনের নিচে ছুঁড়ে মারেন। সেসব শহীদদের ভুলে যান যাদের রক্তের বিনিময়ে সালতানাতে ইসলামিয়া উন্দলুসের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো।