তবুও প্রত্যেক যুগেই কিছু স্বাধীন বীরপুরুষ আল্লাহ তাআলা পাঠিয়ে দেন, যারা ইসলামের পড়ন্ত ঝাণ্ডাটি অতি দৃঢ়-দামাল হাতে সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় তুলে ধরে। এদের মধ্যে একজন সালার উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ বালান্সী এবং আরেকজন হলেন হাজিব আবদুল করীম।
তাদের অধীনে কিছু ঈমানদীপ্ত প্রাণপুরুষও ছিলো যারা তাদের শাসকদের ভোগবিলাসের জীবনে মত্ত দেখে নিজেদের দায়িত্ব পালনের সামান্যতম ত্রুটি করেনি।
সালারে আলা- প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ রাতে রাতেই তার সেনা ইউনিটগুলোর কমান্ডার ও পদস্থ কর্মকর্তা ও সহযোগীদের ডেকে তুললেন। তাদেকে জরুরি গলায় জানালেন, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। এ থেকে আমদের মনযোগ সরানোর জন্য আমাদের সীমান্ত এলাকায় দুশমন হামলা চালাচ্ছে।
প্রচণ্ড এক ঝড় আমাদেরকে লণ্ডভন্ড ও ধ্বংস করে দিতে উঠে আসছে। সালারে আলা উবাইদুল্লাহ সবার উদ্দেশ্যে বলতে শুডরু করলেন, এটা ঠিক যে সৈন্যদের যে কোন হুকুম মানতে হয়। পাহাড়, পর্বত, নদী-সমুদ্র, উত্তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে যেখানেই তাদেরকে যেতে নির্দেশ দেয়া হয় সেখানে তাদের যেতে হয়। লড়তে হয়। অকুণ্ঠ চিত্তে প্রাণ দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু আল্লাহর সৈনিকরা তো অন্যান্য জাতির সৈনিকদের থেকে একেবারেই ভিন্নতর।……
তারা পবিত্র এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লড়াই করে। কোন ব্যক্তি মানুষ, কোন খান্দান বা গোষ্ঠির শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা লড়াই করে না। একমাত্র আল্লাহর শাসন মানবজাতির হৃদয়রাজ্যে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর সৈনিকরা লড়াই করে। আমরা তো পবিত্র কুরআনের সেই হুকুমের ওপর অটল থেকে লড়াই করি যে,
যে পর্যন্ত কুফরের কর্মতৎপরতার মূলোৎপাটন না হবে সে পর্যন্ত তোমাদের ওপর অবিরাম জিহাদ ফরজ।…..
নিজেদের সৈনিকদের মনে এ কথাটা ভালো করে গেঁথে দাও যে, উন্দলুসের পূর্বপুরুষ বীর সেনানীরা এখানে যে মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলো তা জীবন্ত রাখতে হবে। তাদেরকে বলবে, এই পবিত্র মাটি সেসব শহীদ আত্মাদের আমানত যারা খুব স্বল্প সংখ্যকের একটি দল হয়ে এখানে এসেছিলো। তারপর তাদের নৌযানগুলো পুড়িয়ে ফেলে। যাতে কারো মনে ফিরে যাওয়ার কল্পনাও না আসে। ….
আজ আমাদের প্রয়োজন এমন হার না মানা জযবা- ঈমানদীপ্ত চেতনার। আর আমি যে সব কথা তোমাদেরকে বলছি তা তোমাদের সৈনিকদেরকে বলো আর না বলো, নিজেরা গভীর মনে শুনে রাখো, কিছুকাল ধরে খলীফার পক্ষ থেকে উন্দলুসে এমন আমীর নিযুক্ত হচ্ছে যারা নিজেদেরকে বাদশাহ বলতে পছন্দ করেন। এটা তো অনৈসলামিক রীতি-নীতি। ইসলামে কোন রাজা-বাদশাহ নেই।…..
কিন্তু আমাদের ওপর এমব বাদশাহ চেপে বসেছেন, যিনি আল্লাহ ও রাসূলের নাম নেন ঠিক, কিন্তু তার প্রতিটি কাজ আল্লাহ ও রাসূলের বিধি বিধানের পরিপন্থী। তিনি হেরেমও আবাদ করেছেন। যাতে অতি রূপসী কালনাগিনী প্রতিপালিত হচ্ছে। আমাদের বর্তমান আমীরও তেমন।…..
আমি জানি, তোমাদের অনেকর মনে এই অনুযোগ রয়েছে, নিজেদের আমীরের চেহারাখানি কোন দিন দেখোনি। তিনি নিজে কখনো এসে দেখেননি, তোমাদের কি অবস্থা? তোমরা এখানে কেমন আছো?
তোমাদের অনেকেই হয়তো জানো, আমদের আমীর গান-বাদ্য ও ভোগ-বিলাসে ডুবে আছেন। হয়তো এ কারণে কারো মনে এটাও আসতে পারে, নিজেদের আমীর যখন এমন তাহলে আমাদের জানবাজি রেখে, যখমী হয়ে লড়াইয়ের কী দরকার?
এমন ভাবনা মনে আসলে তা ঝেটিয়ে দূর করে দাও। এটা আল্লাহর রাজত্ব। কোন বাদশাহ বা আমীরের নয়। তোমরা এর আমীন-বিশ্বস্ত রক্ষক। প্রত্যেককে যার যার কবরে গিয়ে শুতে হবে, বাদশাহকেও তারই নির্ধারিত কবরে নামানো হবে। আমি আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, যে দেশে কুরআনের শাসন চলে সেখানে কোন এক ব্যক্তি বা তার খান্দানের জায়গীর হয় না, সেটা সে দেশের জনগণের সবার দেশ। আমাদের সবার দেশ। আমাদেরকে বাদশাহর সামনে না, আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে……
এজন্য মুসলমান কোন রাজা-বাদশাহ, আমীর উমারা, সালার, সিপাহসালার বা কমান্ডারদের জন্য লড়াই করে না। মুসলমান লড়াই করে একমাত্র আল্লাহর পথে। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। মুসলমান লড়াই করে বিজয়ের জন্য। পরাজয়ের জন্য মুসলমান লড়ে না। পরাজয়ের চেয়ে মুসলমানের কাছে মৃত্যুই। শ্রেষ্ঠ।
নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার। উপস্থিত সবার ধ্বনিত শ্লোগানে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেলো।
উবাইদুল্লাহ সালার ও কমান্ডারদেরকে হুকুম দিলেন ফজরের পরেই সেনাদল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে।
***
কোচ করার গতি ছিলো অতি তীব্র। তাই সূর্যোদয়ের আগেই ফৌজ শহর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আবদুর রহমানের ঘুম ভাঙ্গতেই তিনি তার সচিবকে ডেকে বললেন, প্রধান সেনাপতিকে যেন পয়গাম পাঠানো হয়, শাহে উন্দলুস ফৌজকে বিদায় জানাতে ফৌজের সঙ্গে কিছু দূর এগিয়ে যাবেন।
ফৌজ শহর থেকে বেরিয়ে গেছে শাহে উন্দলুস! সচিব জবাব দিলো। বাইরে প্রধানমন্ত্রী আবদুল করীম আপনার অপেক্ষায় আছেন।
তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও। আবদুর রহমান হুকুম দিলেন।
হাজিব ভেতরে আসতেই আবদুর রহমান একটু ক্ষুণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
উবাইদুল্লাহ কি এতটুকু অপেক্ষা করতে পারলো না যে, ফৌজ আমাকে বিদায়ী সালাম জানিয়ে যাবে?