আমার মতামতও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তিনি তো মালিকায়ে তরূব ও গায়ক যারিয়াবের দখলে রয়েছেন এখন। এরা তো জিন ভূতের চেয়েও ক্ষমতাবান। ওরা এমন এক দেয়াল তুলে রেখেছে যে, ওতে আমরা দুজন প্রবেশ করতে পারবো না।
চেষ্টা করবো দেয়াল ফুড়ে ঢুকতে। বললে এখনই যাওয়া যায়। উবাইদুল্লাহ দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন।
***
২. হাজিব ও উবাইদুল্লাহ
হাজিব ও উবাইদুল্লাহ তাদের দুই গুপ্তচর নিয়ে আবদুর রহমানের মহলে চলে গেলেন।
আবদুর রহমানকে খবর দেয়া হলো প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি কোন বিশেষ কাজে দেখা করতে এসেছেন। এটা শুনেই সুলতানা মালিকায়ে তরূব বেরিয়ে এলো। গায়ে তখন তার এমন সংক্ষিপ্ত পোষাক যে, তাকে উলঙ্গ বললে অপরাধ হবে না। তার চোকে মুখে অসন্তুষ্টি আর বিরক্তি।
আপনারা কি দিনের বেলা দরবারে উনার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না? সুলতানা প্রজা শাসনের গলায় বললো, তিনি এই মাত্র যারিয়াবকে ডাকিয়েছেন। এসময় শাহে উন্দলুস দেখা করতে পারবেন না।
আমাদের এখনই উনার সঙ্গে দেখা করতে হবে। উবাইদুল্লাহ তাকে পাত্তা দিয়ে বললেন, আমরা হুকুম গ্রহণ করবো তার কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে নয়। তাকে গিয়ে বলো তার সঙ্গে দেখা না করে আমরা এখান থেকে। যাবো না।
আর আমিও আপনাদের দুজনকে তার সঙ্গে দেখা করতে দেবো না। সুলতানা ঘাড় বাঁকা করে এক রোখা কণ্ঠে বললো।
এমন অপমানের পরও তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? হাজিব উবাইদুল্লাহকে বললেন।
আমি এখানে দাঁড়য়ে থাকবো না। কিন্তু ফিরেও যাবো না। ভেতরে যাবো। হেরেমের এক মেয়ে মুখে মুখে সম্রাজ্ঞী বনে বসে আছে। ওর মতো ছুড়ির সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টিতে আমার কিছুই যায় আসে না। সেনাপতি উবাইদুল্লাহ তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন।
শাহে উন্দলুসের খাস কামরা থেকে যারিয়াবের সুরের গুঞ্জরণ ভেসে আসছে। এই গুঞ্জরনের ভেতর থেকে আবদুর রহমানের আওয়াজ ভেসে এলো।
সুলতানা! কোথায় গেলে! ওদেরকে বলো কাল আসতে।
উবাইদুল্লাহ আর দেরি করলেন না। আবদুর রহমানের কামরায় চলে গেলেন। হাজিব আবদুল করীমও তার পেছন পেছন গেলেন। এর পেছনে কামরায় ঢুকলো সুলতানা। আবদুর রহমান আধশোয়া হয়ে আছেন। চোখ দুটি নেশাকাতর-অর্ধ খোলা।
শাহী মহলের আদব সম্পর্কে কি ওদের জানা নেই? সুলতানা রাগত কণ্ঠে বললো।
কোন জরুরি কথা হবে হয়তো সুলতানা! আবদুর রহমান আচ্ছন্ন গলায় বললেন, এত তাড়াতাড়ি রেগে যেয়ো না। এসো, আমার পাশে বসো।
তারপর হাজিব ও উবাইদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
আরে, এমন কোন কেয়ামতের বিভীষিকা নেমে এসেছে যে, তোমরা রাতটা পার হওয়ার অপেক্ষা করলে না? তোমাদেরকে বলাও হয়েছে, আমি এখন দেখা করতে পারবো না, তারপরও ভেতরে এসে গেলে! তোমরা কি তোমাদের পদাধিকার ও অবস্থানের কথা ভুলে গেছো?
হ্যাঁ, আমীরে উন্দলুস! উবাইদুল্লাহ বললেন, আমরা আমাদের পদ মর্যাদা ও অবস্থানের কথা ভুলে গেছি। এই পবিত্র ভূমির বিজয়ী বীর সেনানীরা এখানে কোন পদ মর্যাদা ও সম্মান লাভের স্বার্থে এদেশ জয় করেননি। যেসব শহীদরা এই এলাকায় আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপরাজেয় ঝাণ্ডা উড়াতে গিয়ে নিজেদের রক্ত ঢেলে শহীদ হয়েছেন তারা প্রতিদানে কি পেয়েছেন?….
এর প্রতিদান কি এটাই যে, এক অর্ধ উলঙ্গ রক্ষিতা শহীদদের এই পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে এক সালার ও এক ওযীরকে হুকুম দেয়- তোমরা এখান থেকে চলে যাও?
উবাইদুল্লাহ! আবদুর রহমান আচ্ছন্নতা ভেঙ্গে প্রায় গর্জে উঠে বললেন, কি হয়ে গেছে তোমার? তুমি কি বলছো এসব?
তিনি আধশোয়া থেকে সটান উঠে বসলেন। তার নেশাতুর চোখ পুরোপুরি খুলে গেলো। যারিয়াবের গান বাদ্যও নীরব হয়ে গেলো। সুলতানা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত পিষছে। আবদুর রহমানের চেহারা রক্তবর্ণা হয়ে উঠলো। না, ক্রোধের বর্ণ নয় এটা। এটাই তার প্রকৃত পুরুষালী বর্ণ।
তার দৃষ্টি উবাইদুল্লাহ, হাজিব, যারিয়াব ও সুলতানার ওপর একে একে ঘুরে এলো। যেন আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে সবাইকে দেখছেন। তার দৃষ্টি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে এলো।
***
তোমরা দুজন কি বসবে না? আবদুর রহমান হাজিব ও উবাইদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন এবং যারিয়াব ও সুলতানাকে বললেন, তোমরা দুজন পাশের কামরায় গিয়ে বসো। মনে হচ্ছে কোন জরুরি ব্যাপার ঘটেছে। না হয় এরা দুজন এভাবে আসতো না যেমন আজ কোন অনুমতি ছাড়া ভেতরে চলে এসেছে।
তার কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
যারিয়াব ও সুলতানা চলে গেলো। উবাইদুল্লাহ ও হাজিব বসে পড়লেন।
আবদুর রহমান যেভাবে যারিয়াব ও সুলতানার সামনে ক্ষমাপ্রার্থনা ভঙ্গি করলেন সেটা প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতিকে হতভম্ব করে দিলো। তারা একে অপরের দিকে তাকালেন। যেন চোখে চোখেই ঠিক করে ফেললেন, আজ চূড়ান্ত কথা বলে যেতে হবে।
বলল, কি কথা তোমাদের? আবদুর রহমান বললেন।
আপনাকে খলীফা উন্দলুসের আমীর নির্বাচিত করেছেন, উবাইদ্রাহ বললেন, কিন্তু দরবারের স্বার্থান্বেষীরা, তোষামোদকারীরা এবং পা চাটা চামচারা আপনাকে শাহ উন্দলুস বলতে শুরু করেছে। আর আপনিও বাদশাহ হয়ে বসে আছেন।
তুমি কি বলতে চাও উবায়েদ! আবদুর রহমান বাদশাহী মেজাজে বললেন, তুমি নিজেকে সবসময় যুদ্ধের ময়দানে রেখে কথা বলো। তোমার চিন্তা ভাবনা ও সব কিছুর মধ্যেই লড়াই বেঁধে থাকে। তুমি কি শান্ত হয়ে সে কথাটা বলতে পারো না যেটা বলতে এসেছে এই গভীর রাতে।