ওদের জীবনাচরণ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রুচি স্বভাব বদলে দাও। ইউগেলিস যারিয়াবকে বেশ কিছু কথা বলার পর বললো, যে জাতি নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যায় সে জাতি বেশি দিন বেঁচে থাকে না। তারা স্বাধীনও থাকতে পারে না এবং কোন দেশ শাসন করারও যোগ্য থাকে না।…..
আমি জানি, এতে সময় লাগবে। কয়েক বছর লেগে যাবে। কিন্তু কোন জাতিকে চিরদিনের জন্য নিঃশেষ করে দিতে এর চেয়ে উপযুক্ত কোন উপায়ও নেই। এর বিপরীতে আমরা যদি শাহে উন্দলুসকে যুদ্ধের ময়দানে চ্যালেঞ্জ করে বসি তাহলে আরব থেকে কাতরে কাতারে সৈন্য এসে যাবে। তাই শাহে উন্দলুস আবদুর রহমানকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
ইউগেলিস ও সুলতানা কথায় কথায় যারিয়াবকে দরবারী গায়ক থেকে এক রাজ্যের রাজা ও সুলতানাকে তার রানী বানিয়ে দিলো।
সুলতানা যারিয়াবকে তার জায়গীরে তিন দিন আতিথ্য দান করলো। তার জায়গীরটি সুসজ্জিত কয়েকটি বাগানে পরিবেষ্টিত হয়ে অতি মনোগ্রাহী জায়গায় পরিণত হয়েছে। এই তিন দিন সেসব বাগানেই তাদের অধিক সময় কাটলো।
যারিয়াব যখন শাহী মহলে ফিরে এলো তখন তার চিন্তা ভাবনা, স্বপ্ন-বিশ্বাস এমনকি তার আচার আচরণও পাল্টে গেলো। তার সুর আগের চেয়ে আরো মনকাড়া হয়ে উঠলো।
সুলতানা তার চেষ্টায় যারিয়াবকে আবদুর রহমানের ওপর আগের চেয়ে আরো কয়েকগুণ বেশি সওয়ার করে দিলো। সুলতানার মতো আবদুর রহমানের দৈনন্দিন জীবনে যারিয়াবও বিশাল অংশ দখল করে নিলো।
***
সময় যেমন অতি দ্রুত বয়ে চলছে তেমনি ইউগেলিসি, সুলতানা ও যারিয়াবের সমন্বিত মাটি ফোঁড়া মিশনও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে।
এক রাতে শাহে উন্দলুসের প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম ইবনে আবদুল ওয়াহিদ সঙ্গে দুজন লোক নিয়ে সিপাহসালার-প্রধান সেনাপতি উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহর বাসভবনে গিয়ে হাজির হলেন।
উবাইদুল্লাহ ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাদেরকে বসালেন। হাজিব আবদুল করীম তাকে কোন ধরনের লোক-সৌজন্যতা দেখাতে নিষেধ করলেন।
উবাইদ! হাজিব সেনাপতিকে বললেন, এই দুজন লোককে চেনো? তার সঙ্গে আসা লোক দুজনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, কেন নয়? উবাইদুল্লাহ জবাব দিলেন, এরা আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। গোপন সব তথ্য উদ্ধার করে আনে।
তাহলে শোনো, এরা কি খবর নিয়ে এসেছে? হাজিব দুজনকে রিপোর্ট শোনাতে ইংগিত করলেন।
মহামান্য সিপাহসালার! তাদের একজন বললো, কর্ডোভার সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে, তুলায়তা, মুলায়কা ও বার্সিলোনা রাজ্যগুলোতে খ্রিস্টানরা সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা অতি গোপনে সেসব মুসলমানদেরকে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে যারা কিছুদিন আগে খ্রিষ্ট ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হয়েছিলো। এরা দুমুখো সাপ।
এই দুমুখোরা আমাদের সঙ্গে নামাযও পড়ে। আরেকজন গুপ্তচর বললো, আবার পর্দার আড়ালে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিগগিরই এরা মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়াবে। ওদের এটাও জানা আছে, সংখ্যায় ওরা যত বেশিই হোক, আমাদের সেনাবাহিনীর সামনে বেশি দিন টিকতে পারবে না। কিন্তু ওরা প্রাণপাত করার শপথ নিচ্ছে।
এরা আরো জানালো, শাহ লুই এই বিদ্রোহের পালে হাওয়া দিচ্ছেন। আর খ্রিষ্টান অঙ্গরাজ্য গোথাক মার্চের রাজা ব্রেন হার্ট উন্দলুসের সীমান্ত এলাকায় হামলা চালিয়ে যতটা পারে ততটা এলাকা দখল করে নেবে।
এই গোয়েন্দারা নওমুসলিম খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশ ধরে খ্রিষ্টানদের দলে ঢুকে পড়ে। তারপর তাদের গোপন তৎপরতার খুঁটিনাটি বের করে নিয়ে আসে। তারা আরো জানায়, ইউগেলিস নামের এক খ্রিষ্টান এই বিদ্রোহের পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
বিদ্রোহের আগুন কয়েক জায়গাতেই লাগার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়ার খবর আগেই পেয়ে যান প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম। তিনি শাহে উন্দলুস আবদুর রহমানকে এ ব্যাপারে সাবধান করতে চাইলে তিনি সেটা মোটেও গুরুত্ব দেননি।
উবাইদ ভাই। হাজিব সেনাপতিকে বললেন, আমাদের আমীর ও বাদশাহ যদি নিজের দেশ সম্পর্কে এমন বেপরোয়া হয়ে যান তাহলে আমাদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? আমরাও কি এমন বেপরোয়া হয়ে যাবো?
না, কখনো না, সেনাপতি উবাইদুল্লাহ বললেন, উন্দলুসের এই পবিত্র মাটি আবদুর রহমানের নয়। এটা সেই স্বাধীন বীর মুক্তি সেনাদের জমি, যারা আরব থেকে আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন। তারা তাদের ঘর-বাড়ি, তাদের সন্তানদের কাছে ফিরে যাননি।
এটা আমাদের ও সালতানাতে ইসলামিয়ার দুর্ভাগ্য যে, উন্দলুসের শাসকরা এক খান্দান ও এক গোত্রের পরিত্যজ্য সম্পদ হিসাবে একে আঁকড়ে ধরে আছে। একে নিজেদের পিতৃপুরুষদের উত্তরাধিকার সম্পদ মনে করছে।…..
এরা শাহী খান্দান বনে গেছে। তাদের এ দেশর মাটি ও এদেশের মানুষের ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। তাদের সব আগ্রহ-আকর্ষণ বাদশাহী ও ভোগবিলাসী জীবনেই সীমাবদ্ধ। দেশের আসল শত্রু তো এই শাসক শ্রেণীই, যারা তোষামোদকারীদের বেষ্টনীতে বসে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে।…..
এটা আমাদের পালনীয় কর্তব্য, দেশকে কুফরীর করালগ্রাস থেকে বাঁচানো। বিদ্রোহ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের খবর আমিও পাচ্ছিলাম। আজ তুমিও সেটার সত্যায়ন করলে। আমার পরামর্শ মতো চলুলে আমাদের দুজনেরই আবদুর রহমানের কাছে যাওয়া উচিত।