ইউগেলিস বইটির কয়েকটি কপি করালো। সেগুলো বিভিন্ন গির্জায় বন্টন করে দিলো আর পাদ্রীদেরকে বলে দিলো, তারাও যেন এগুলোর কপি তৈরী করিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা, ভিত্তিহীন কথাবার্তা, আপত্তিজনক ও অশ্লীল মন্তব্য দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে গেলো।
মুসলিম শাসক যাদেরকে ইসলাম আমীর বলে সম্মানিত করেছে। তারা এতে সন্তুষ্ট না হয়ে নিজেদেরকে রাজা বাদশাহ বলতে লাগলো। তারা টেরই পেলো না, সারা দেশে ইসলাম ও সালতানাতে উন্দলুসের বিরুদ্ধে কী বিষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
ইউগেলিস শহরের পর শহর ঘুরে ঘুরে শাহে ফ্রান্স পর্যন্ত পৌঁছে। সে ইসলাম ও ইসলামী সালতানাতের পতনকে তার জীবনের মিশন বানিয়ে নেয়। প্রতিটি গির্জায়, দেশের প্রতিটি শহরে অলিগলিতে এসব কথা শোনা যেতে লাগলো যে, খ্রিষ্টধর্ম ছেড়ে দিলে পরবর্তী প্রজন্মও মুসলমানদের গোলাম হয়ে থাকবে।
সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী তারাই হয় যারা নিজেদের ধর্মের ব্যাপারে আত্ম সচেতন। মুসলমানদের ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে গেছে। কারণ, তাদের শাসকরা নিজেদের ওপর মদ, নারী ও নর্তকীদেরকে সওয়ার করে নিয়েছে। সিংহাসন ও রাজমুকুটই এখন তাদের ধর্ম হয়ে গেছে। তারা তাদের জাতিকে এখন ধোকা দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।….
মুসলিম জাতি থেকে তাদের লড়াকু মনোভাব ও সেই দৃঢ় সংকল্প-মনোবল দূর হয়ে যাচ্ছে, যার সাহায্যে তারা অর্ধেক দুনিয়ায় বিজয় কেতন উড়িয়েছিলো। এখন তাদের বাদশাহরা তাদেরকে সে অবস্থানে নিয়ে গেছে যেখান থেকে আর কোন তারিক ইবনে যিয়াদের আবির্ভয়াব ঘটবে না। এই জাতি এখন বন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাদশাহী হবে খ্রিষ্টীয় জাতির। শাসন চলবে ক্রুশের।
ইউগেলিস সুলতানা মালিকায়ে তরূবকে যে আন্দোলনের কথা বলেছিলো সেটা ইতিহাসে স্থান পেয়েছে মুআল্লিদনি আন্দোলন নামে। এর ইংরেজী নাম RENEGADES এর অর্থ হলো, ধর্মের ব্যাপারে যারা দুমুখী।
মুআল্লিদীন বা দুমুখী ধর্মানুসারী সেসব খ্রিষ্টানকে বলা হতো, যারা কোন এক সময় মুসলমানদের আচার আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে এবং পরে ব্যক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্য খ্রিষ্টধর্মে ফিরে যায়; কিন্তু প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। তুলাইতা, মুলয়কা ও কর্ডোভায় এদের সংখ্যা ছিলো বেশি।
ইউগেলিসের মতো যখন এসব দুমুখী মুসলমানরা যোগ্য নেতা-লিডার পেয়ে গেলো তখন প্রকাশ্যে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ না করে মুসলমান রয়ে গিয়ে উন্দলুসের শিকড় কাটতে শুরু করলো।
ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ওরা মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে এবং সাধারণ মুসল্লীরা পাক্কা মুসলমান মনে করতো তাদেরকে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা ইসলামের চরম শত্রু হয়ে খ্রিষ্টধর্মে ফিরে যায়।
ইউগেলিস তার আরেকজন সহযোগী পেয়ে যায়। সে হলো ইলিয়ার। দুজনই প্রথমে এক খ্রিষ্টান পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারক সিনেট জুওয়াইলিসের ছাত্র ছিলো। পরে ইবট স্পেয়ারান্দিয়ো এর মতো বিখ্যাত খ্রিষ্টান পন্ডিতের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। স্পেয়ারান্দিয়ো ইসলামের বিরুদ্ধে অতি আপত্তিজনক একটি বইও লিখেন।
***
সুলতানা মালিকায়ে তরূব তার জায়গীরে যাওয়ার সময় আবদুর রহমানকে বলে যায়, সে দুতিন দিন ওখানে থাকবে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে সে ওখানে গিয়েছিলো সেটা প্রথম দিনেই হাসিল হয়ে যায়। সেখানে সে এক রাতই থাকে। আর এটা হয়ে যায় তার জীবনের এক স্মরণীয় রাত।
ইউগেলিসের মুখের ভাষায় দরুণ আকর্ষণ রয়েছে। তার ব্যক্তিত্বেও ছিলো অন্যকে কাছে টানার মতো চমক জাগানো। তাই সুলতানার ভালো লেগে যায় তাকে। তা ছাড়া ওকে যে খুশি রাখাও দরকার এটাও সে বুঝে গেছে। কারণ, এত বড় চক্রান্তের মূল হোতা তো ইউগেলিসই। তার হাত ধরে সে একটি অঙ্গরাজ্যের সম্রাজ্ঞী হতে যাচ্ছে।
কিন্তু সুলতানা লক্ষ্য করেছে, ইউগেলিস তার দিকে সেই দৃষ্টিতে তাকায় না যে দৃষ্টিতে কোন পুরুষ কোন নারীর দিকে তাকায়। কিংবা আবদুর রহমানও যে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকানোর পর তাকে কিনে নিয়েছেন।
রাতে ইউগেলিস সুলতানার বাড়িতেই রইলো। তাকে জানালো, ভোরের অন্ধকার থাকতে থাকতে সে বেরিয়ে যেতে চায়। ইউগেলিস তাকে বললো,
‘সুলতানা! জল্লাদের তলোয়ার আমার মাথার ওপর ঝুলে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত আমার মৃত্যুভয়ে কাটে। বাইরে তোমার শাহী মুহাফিজ প্রহরায় দাঁড়িয়ে। ওরা যদি আমার আসল পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারে তো সূর্যোদয়ের আগেই আমার গর্দান কেটে নেবে। এজন্য আমি বিয়ে করিনি। কোন মেয়েকে আমি বিধবা ও সন্তানদেরকে এতিম করতে চাই না। আমার মিশনের জন্য আমি আমার সব আবেগ পায়ে পিষে দিয়েছি।‘
রাতে সে পৃথক কামরায় ঘুমালো। মাঝরাতের খানিক পর তার চোখে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। তার চোখ খুলে গেলো। বিদ্যুৎ-বেগে কোমরবন্দ থেকে খঞ্জর বের করে ফেললো। সুলতানা না বললে পর মুহূর্তেই খ র তার বুকে আমূল বিদ্ধ হয়ে যেতো।
কেন? কি হয়েছে? কি খবর এনেছো? ইউগেলিস ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
কিছু হয়নি। তোমার যৌবনের আবেগ জাগাতে এসেছি ইউগেলিস! সুলতানা তার বিছানায় আধশোয়া হতে হতে তার গলা ধরে বললো, যে কথা তুমি বলতে পারোনি সেটা আমি জানি। নিজেকে এভাবে জ্বালিয়ো না।