নিজের আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত না হলে যে কোথাও সে দুদন্ড শস্তি পাবে না এটা তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
সুলতানা আরো ভেবেছিলো, তার ছেলে আব্দুল্লাহর জন্য সিংহাসনের পথ পরিস্কার করতে যারিয়াবের প্রভাবকে কাজে লাগাবে। যারিয়াব তার সেই আশায় সোজা পানি ঢেলে দিয়েছে। তাই যারিয়াব চলে যেতেই সুলতানা ঘৃণাভরে বলে উঠলো,
শালা বুড়ো অকর্মা! এখন যখন কোন নারীর যোগ্য তো দূরের কথা নিজের জন্যও যখন অযোগ্য হয়ে পড়েছে তখন বেটা ওয়ালিআল্লাহ বনে গেছে। এখন আমীরে উন্দলুসের মুরিদ হয়ে গেছে। এই বুড়োর চেয়ে আমার ক্ষমতা এখন অনেক বেশি।
পুরো প্রশাসনে ঝড় বয়ে দিতে পারে এমন লোকও আমার হাতে আছে। আমি এক দিক থেকে শুরু করবো, প্রথম আব্দুর রহমানই। তারপর মুদ্দাসসিরা। তারপর…
তার রগ-রেশায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। তার ভেতরের সব শয়তানী শক্তি জেগে উঠলো।
আমীর আব্দুর রহমানের এক মুক্তিপ্রাপ্ত কৃতদাস নসর। এর উল্লেখ দেখা যায় ইতিহাসে। সে খুব তীক্ষ্ম মেধার অধিকারী ছিলো। আব্দুর রহমান তাকে শুদু গোলামি থেকে মুক্তই করেননি দরবারেও তাকে এক উঁচু পদ দান করেন। নসরের এক দিক ছিলো শয়তানিতে পূর্ণ। সুলতানা এটা বুঝতে পেরে শুরু থেকেই নসরকে তার গোলাম বানিয়ে নেয়।
সুলতানা আব্দুর রহমানের কাছে সব সময় তার অনেক প্রশংসা করতো। সুলতানা তাকে অনেক ধন-সম্পদও দান করে। নসর এখন যারিয়াবের মতো প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছে। এখনো সে সুলতানার অনুগত।
পর দিন সূর্য মাথার ওপর উঠে আসার পর সুলতানার চোখ খুললো। ঘুম ভাঙ্গতেই সে খাদেমাকে ডেকে বললো,
নসরকে ডেকে নিয়ে আসো। আসার সময় যেন কারো নজরে না পড়ে।
নসর আসতেই তাকে পালংকের ওপর বসালো। নিজে তার সঙ্গে লেগে বসলো। কিছুক্ষণ অতীতের কথাবার্তা বলে তরল ধরণের রসিকতা শুরু করলো।
বুড়ো নসর যখন গরম হয়ে উঠলো তখন তার কানের সাথে নিজের মুখ লাগিয়ে ফিস ফিস করে কি যেন বললো। নসরের দুচোখ বড় বড় হয়ে উঠলো।
এই পাপও আমার হাতে করাবেন? নসর হয়রান হয়ে বললো।
হ্যাঁ, নসর! এই পাপও তোমার হাতে করাবো। সুলতানা নাগিনীর মূর্তি ধারণ করে বললো, সেই সুন্দর সুন্দর পাপগুলোর কথা স্মরণ করো যা আমার বখশিশের লোভে তুমি করে এসেছে। এর মধ্যে কিছু পাপ তো এমন আছে যা আজো তোমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে পারে।…….
তুমি কি জানো না, জল্লাদের তলোয়ার আমার ইশারায় চলবে? আমার এ কাজটি করে দাও। তাহলে আমার ছেলে হবে আমীরে উন্দলুস। আর তোমার ছেলে হবে ফৌজের প্রভাবশালী সালার।
নসর যেন শিকলে বাঁধা পড়লো। সে জানে, সুলতানা নাগিনী। যাকে ছোবল দেবে সে শেষ হয়ে যাবে। তার সন্তানের ভবিষ্যৎ কল্পনার চেয়ে উজ্জল। সে হেসে বললো,
আমি না করলে এ কাজ আর কে করবে?
অনেক্ষণপর নসর সুলতানার ঘর থেকে বের হয়ে শাহী ডাক্তার হুররানীর কাছে গেলো। হুররানী এখন অশীতপর বৃদ্ধ। নসরের কথা শুনে হুররানীর আপদমস্তক কেঁপে উঠলো।
আপনার জন্য দুটি পথ খোলা রয়েছে। নসর হুররানীকে বললো, একটা হলো, এই বয়সে কয়েদখানার সেসব ভয়ংকর নির্যাতন ভোগ করা যা সদ্য যুবক। কোন লোকও সহ্য করতে পারবে না।……….
আপনি জানেন, আমার মুখ থেকে আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগই বের হতে তা কোন প্রমাণ ছাড়াই সত্য বলে সাব্যস্ত হবে। তখন আপনার বাকি জীবনটা কয়েদখানায় কাটাতে হবে। আরেকটা পথ হলো, এই দুনিয়াতেই আপনি বেহেশত দেখতে পাবেন। হীরা জহরতের স্তূপ থাকবে আপনার সামনে, আপনি ভেবে দেখুন।
হুররানী ভয়ে এতটুকু হয়ে গেলেন। নিজের পরিণাম সম্পর্কে এমনভাবে ঘাবড়ে গেলেন যে, কাঁপা হাতে বিষের একটা ট্যাবলেট নসরের হাতে তুলে দিলেন। ইতিহাসে এর নাম লেখা হয়েছে, লিবয়ানুল মানুক।
এ বিষ মুহূর্তের মধ্যেই প্রাণ নাশ করে দেয়। নসর তাকে এটা বলেনি যে, বিষ কার ইঙ্গিতে নিয়ে যাচ্ছে।
আব্দুর রহমানের স্ত্রী মুদ্দাসসিরার বয়স সুলতানার চেয়ে কম। তবুও প্রৌঢ়ত্বের প্রচ্ছন্ন ছায়া তার মধ্যেও পড়তে শুরু করেছে।
একদিন সন্ধ্যায়, ডাক্তার হুররানীর পক্ষ থেকে এক মহিলার মাধ্যমে মৌখিক পয়গাম পেলো মুদ্দাসসিরা যে, যে কোন অসুস্থতার অজুহাত ধরে আমাকে ডেকে পাঠান। একটু পর মুদ্দাসসিরা খাদেমাকে ডেকে বললো,
আমার পুরো শরীরে ব্যথা ছাড়িয়ে পড়েছে। এখনই শাহী হাকিমকে ডেকে আনো।
খাদেমা ছুটে গেলো এবং হুররানী এসে গেলো।
মালিকায়ে আলিয়া! হুররানী মুদ্দাসসিরাকে বললো, আজ আমার সে দিনের কথা মনে পড়ছে যেদিন সুলতানা আমার কাছ থেকে বিষ নিয়েছিলো আপনাকে হত্যা করার জন্য এবং আমি আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম, সুলতানার পক্ষ থেকে কোন খাদেমা আপনাকে কোন দুধ বা শরবত দিলে সেটা আপনি পান করবেন না। কারণ, তাতে থাকবে বিষ।
হা, মুহতারাম! মুদ্দাসসিরা বললো, কত বছর আগের কথা। অথচ মনে হচ্ছে গত কালের ঘটনা। আমারও মনে আছে, মানসিকভাবে আপনি এতই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে, এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছিলেন। আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি যাবেন না। হতে পারে, একদিন আমীরে উন্দলুসকে দেয়ার জন্যও আপনার কাছ থেকে বিষের পুরিয়া নিতে পারে কেউ।
তখন আপনি তাকে সতর্ক করে দেবেন। জানি না তখন কেন এ কথা বলেছিলাম… সেই ঘটনা এখন কেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন? আপনি কি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছেন?