সেই মহিলা বললো, ওরা জার্মানি দস্যুদল। এদেরকে নারমানও বলা হয়। ওরা আমাদের বসতিগুলো উজাড় করে দিয়েছে। ফসল ছাড়া আমাদের কাছে কিই বা আছে? ওরা ফসল, গবাদি পশু নিজেদের সাথে করে নিয়ে যায়। সুন্দরী মেয়ে ও শিশুদেরকেও ওরা উঠিয়ে নিয়ে যায়। তারপর তাদেরকে সমুদ্র তীরবতী দেশগুলোতে বেঁচে দেয়।….
আমরা যাবোই বা কোথা? ওদের চামড়ার ডিঙ্গি নৌকাগুলো আমাদের উপকূলে একবার নোঙ্গর করার পর আমাদের লোকেরা সব পালিয়ে যায়। এই মেয়ে দুজন আমারই মেয়ে। ওদের নিয়েই সবচেয়ে দুশ্চিন্তা ছিলো।……
ওদেরকে নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকাই। সাথে ছিলো ছোট একটি বাচ্চা। রাতে এমন ভয়ংকর ঠান্ডা পড়ে যে, বাচ্চাটি তাতেই মারা যায়। আমি তো পাগল হয়ে যাই। আমার স্বামী বলে, চলো আমরা কর্ডোভায় যাই।
জানি না ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরতে মরতে পড়তে পড়তে কতদিনে এখানে এসে পৌঁছেছি আমরা। আপনার তলোওয়ার যদি ওই জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত না হয় তাহলে কমপক্ষে আমাদের মেয়ে দুটোকে আশ্রয় দিন। আমরা শুনেছি, নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় মুসলমানরা প্রাণপর্যন্ত দিয়ে দেয়।….
সুলতানা! আমীর আব্দুর রহমানের চেহারায় তখন যে রঙ ধারণ করেছিলো আজো আমার সেটা মনে আছে। তিনি দারোয়ানকে ডেকে বললেন,
এদের সবাইকে শাহী মেহমানখানায় নিয়ে রাখে। এদেরকে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় দাও। শাহী খাবার খাইয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলো। আর সালারে আলাকে এখনই আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
আমি দেখলাম আব্দুর রহমানের বৃদ্ধ চেহারায় যৌবনের ঝলক ভেসে উঠলো। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা আমার ওপর এই ফরজ দায়িত্বও আরোপ পরেছেন। এ দায়িত্ব আমি অবশ্যই পালন করবো। তাঁর উদাস ভাব ও বয়সের ভার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তখন।
***
রাত বাড়ছে। যারিয়ারের কথা বলায়ও যেন স্পৃহা বেড়ে যাচ্ছে। সে বলে যাচ্ছে,
সালারে আলা উবাইদুল্লাহ এলে আব্দুর রহমান তাকে বললেন,
আপনার পাঠানো মজলুম ও মজলুমা নারী পুরুষরা আমার কাছে এসেছিলো। আমাদের কাছে অগ্নিপূজক জার্মান দস্যুদের মতো মজবুত জলযান নেই। কিন্তু আমি ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করে হলেও ওদেরকে খতম করতে চাই।
সালারে আলা বললেন, আমাদের কাছে বড় বড় কিছু নৌকা ও ছোট ছোট কিছু জাহাজ আছে। এসব দিয়ে আমরা সামুদ্রিক লড়াইয়ে টিকতে পারবো না। আপনি হুকুম দিলে বড় জাহাজ বেশ কয়েকটা বানানো যাবে। এ সময়ের মধ্যে আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সেই উপকূল অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। যেখানে জলদস্যুরা এসে লুটপাট চালায়।
তৎক্ষণাৎ ফৌজকে কোচ করার হুকুম দেয়া হলো। জলদস্যুদের দুঃসাহস এত বেড়ে গেলো যে, এরা ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে নদীতে এসেও আশে পাশের গ্রামে লুটপাট চালাতে শুরু করে।
কর্ডোভার পাঠানো ফৌজের প্রথম সংঘর্ষ হয় ওয়াদিল কাবীর নামক এক উপত্যকা দিয়ে নদী অতিক্রম করার সময়। জলদস্যুরা লড়াই নদী থেকে উপকূল পর্যন্ত নিয়ে আসে। তারা নৌযান থেকে এমন শিলা বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ করে যে, ফৌজের পিছু হটতে হয়।…..
খুব দ্রুত নৌযান জাহাজ প্রস্তুত হতে লাগলো। কিছু প্রস্তুতকৃত জাহাজও পাওয়া গেলো। উপকূল এলাকার অনেক জায়গাতেই ফৌজ মোতায়েন করা হলো। লুটেরাদের সাথে বেশ কয়েক জায়গায় তাদের লড়াই হয়। এতে উপকূল অঞ্চলে লুট কমে গেলো। এরা সমুদ্রে চলে গেলো। অন্যান্য দেশের জাহাজের ওপর এবার হামলা চালাতে শুরু করলো।
আমীর আব্দুর রহমান ওদেরকে চির দিনের জন্য খতম করে দেয়ার অঙ্গিকার করলেন। তিনি ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুত করালেন। বড় জাহাজ পনেরটি। এর সঙ্গে ছোট জাহাজ ও বড় পাল তোলা নৌকাও আছে অনেক গুলো। নৌপথে লড়াইয়ের জন্য ফৌজ তৈরি করা হলো।
বেশ কয়েক মাস তাদেরকে সমুদ্রে রেখে সামুদ্রিক আবহাওয়ায় অভ্যস্ত করানো হলো। তারপর উপকূলের পাশ ঘেষে বড় বড় বুরুজ নির্মাণ করানো হলো। ওখানে সব সময় প্রহরা নিয়োজিত থাকতো।……
ওরা দূর থেকে জাহাজ বা নৌযানগুলোকে দেখতে পেতো। কোন জাহাজ উপকূলের দিকে আসতে থাকলে এবং সন্দেহজনক হলে বুরুজের ঘোড়সাওয়ার পয়গাম বাহক নৌবাহিনীকে সংবাদ দিয়ে আসতো।….
নারমান জলদস্যুরা একবার তাদের সব যুদ্ধ নৌযানগুলোকে সমুদ্রে একত্রিত করে তাদের যুদ্ধশক্তির প্রদর্শন করলো। আমীর আব্দুর রহমান এ সংবাদ পেয়েই তিনি উপকূলে পৌঁছে যুদ্ধ জাহাজাগুলোর নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তারপর খোলা সাগরে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি তার বাহিনীকে এর আগে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।…
জলদস্যুদের কখনো কারো সঙ্গে বড় ধরণের লড়াই হয়নি। এখন লড়াই এক নিয়মিত ফৌজের সঙ্গে। লড়াইয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই জার্মান জলদস্যু বাহিনীর টনক নড়লো যে, তারা আজ নিশ্চিত মরণ ফাঁদে পড়েছে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে তাদের নৌযানগুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে সমুদ্রে মিশে গেলো। কয়েকটি জাহাজ মাত্র ওরা অক্ষত রাখতে পারলা। এরপর অগ্নিপূজক জলদস্যুদের কেবল নামই রয়ে গেলো। উন্দলুসের উপত্যাকা এবং দূর দূরান্ত পর্যন্ত সাগর নিরাপদ হয়ে গেলো।
সুলতানা যারিয়াবের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তও হলো। সে ভেবেছিলো, যারিয়াব এসে তার পাকা চুল দেখে বলবে, সে এখনো পঁচিশ বছরের যুবতীর মতো রূপসী এবং সতেজ। কিন্তু যারিয়াব তাকে বাস্তবতার নিরেট আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।