উন্দলুসে যে খ্রিষ্টানরা বিদ্রোহ করছে এদের আমি কোন সাহায্য করবো না। এর বিনিময়ে আপনি ফ্রান্সের ওপর হামলা করবেন না। এই অনুগ্রহের জন্য বিনিময় হিসাবে যদি আপনি কিছু চান এবং যা কিছুই চাইবেন আপনার দরবারে সেটা পৌঁছে যাবে।
আমীরে উন্দলুস এই জবাব পাঠান যে, ঠিক আছে। তোমার দেশে হামলা করবো না। এর বিনিময়ে শুধু এতটুকু চাই যে, কখনো উন্দলুসের সীমান্তে এলাকার দিকে চোখ উঠিয়ে তাকাবে না। যদি উন্দলুসের কোন বিদ্রোহী তোমার এলাকায় চলে যায় তাহলে তাকে ঘোড়ার পিঠে বেঁধে এদিকে তাড়িয়ে দিবে। ব্যাস, আর কিছু চাই না।….
আর সুলতানা! এই আমীর আব্দুর রহমানই যিনি সমুদ্রে রাজত্ব করেছেন। সেখানেও তার তলোয়ার ঝলক দেখিয়েছেন। তুমি তো ছিলে এক রহস্যময় দুনিয়ার নারী। তুমি সবসময় চেষ্টা করেছে, আমীর আব্দুর রহমান যেন যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে নেতৃত্ব না দেন।….
কারণ, আমি এটা কখনো চাইতে পারি না যে, যাকে আমি ভালোবাসি সে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে মারা পড়ুক। সুলতানা বললো।
সুলতানা! যারিয়াব আক্ষেপের সুরে বললো, এই বয়সে এসেও যদি তুমি মিথ্যা বলা থেকে তাওবা করে নাও, তবুও তুমি দেখবে দারুণ আত্মিক শান্তি অনুভব করছো। তোমাকে তো উন্দলুসের দুশমনরা নির্দেশ দিয়েছিলো, ওদেরকে এ সাহায্য করতে হবে যে, আব্দুর রহমানকে যুদ্ধের ময়দানে কিংবা কোথাও বিদ্রোহ দমন করার ব্যাপারে যেতে দেবে না। কারণ, আব্দুর রহমানের রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দেয়ার যে জাদুকরী যোগ্যতা রয়েছে এর সামনে দুনিয়ার কোন যুদ্ধ শক্তিই টিকতে পারবে না।….
এ ছাড়াও আমীরে উন্দলুস যখন নিজে ফৌজের সাথে থাকেন তখন তো সালার থেকে নিয়ে সাধারণ সিপাহীরা পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দিয়ে লড়াই করে। কিন্তু তুমি তাকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারোনি। মুদ্দাসসিরা পবিত্র কুরআনের আয়াত পড়ে একটি তলোয়ারে ফুক দিয়ে তার হাতে তলোয়ার তুলে দেয় এবং বলে, যাও আমার মাথার মুকুট! আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন। বিজয় তোমারই হবে।
***
যারিয়াব সুলতানার সামনে অজানা আরেক কাহিনীর দ্বার উন্মোচন করলো। বললো,
আমীরে উন্দলুস নারী ও ভোগ বিলাসপ্রিয় এটা জেনে অগ্নিপূজক ডাকাত ও লুটেরা দলও আব্দুর রহমানের আত্মমর্যাদাবোধকে চ্যালেঞ্জ করে। উন্দলুসের পূর্ববর্তী আমীরদের ব্যাপারেও অগ্নিপূজকরা সমুদ্র পথে কেয়ামতের বিভিষিকা নামিয়ে দিয়েছিলো। ওদেরকে সামুদ্রিক ফৌজ বললেও সঠিক হবে। শক্তিশালী এবং বিশাল এক ব্যটালিয়ান ছিলো ওদের।…।
ওরা অন্যান্য অনেক দেশের শক্তিশালী নৌ বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এরা মূলত: জার্মানীর লুটেরা দল। যারা খোদ জার্মানিতেই বিতাড়িত। সমুদ্রে পছন্দ মতো শিকার না পেলে উপকূলে এসে বসতিগুলোতে লুটপাট চালায়। সাকেন্ড নিওয়া নামক উপকূলে ওদের আড্ডা। ওখানে সমুদ্র এতই বিপদজনক ও ভয়ংকর হয়ে থাকে যে, কোন নাবিকই সেদিকে জাহাজ নিয়ে যেতে দুঃসাহস দেখায় না।…
অগ্নিপূজকদের এই জলদস্যুরা এতই হিংস্র ও রক্ত পিপাসু যে, সমুদ্রের উত্তাল ঝড়ও যেন ওদেরকে সমীহ করে চলে। যে কোন ধরনের নৌযান চালনায় ওদের দক্ষতা অতুলনীয়। সাধারণ ডিঙ্গি নৌকা নিয়েও ওরা বিক্ষুদ্ধ সাগরে বেরিয়ে পড়ে।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমীর আব্দুর রহমান কিছুটা ক্লান্ত হয়ে কামরায় আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। আমাকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যাওয়ার হুকুম পাঠালেন। আমাকে দেখে বললেন,
যারিয়াব! ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বুড়ো হয়ে গেছি না? কিছু একটা শোনাও যারিয়াব! বড় উদাস সুরে।
আমি গিটার বাজাতে শুরু করলাম, গুন গুন করে গান ধরছিলাম। এ সময় দারোয়ান এসে জানালো, সালারে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ কিছু মুসাফির পাঠিয়েছেন। এরা মনে হচ্ছে বড় মাজলুম। এদের সাথে কয়েকজন নারীও আছে।…..
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, আমীর এ সময় কারো সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। কিন্তু আমীর সোজা হয়ে বসলেন এবং আমাকে বললেন, বাদ্যযন্ত্র দূরে সরিয়ে রাখো। এরা যদি মজলুম মুসাফির হয় তাহলে এদের কাছে বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ভালো লাগবে না।
তিনজন লোক ভেতরে এলো। এদের সাথে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা ও দুইজন যুবতী মেয়ে ছিলো। ধূলো মলিন কাপড় চোপড়েও মেয়ে দুজনকে বেশ সুন্দরী লাগছিলো। মহিলা ও মেয়ে দুজনের চোখ অশ্রু ভেঝা। এরা সবাই মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো এবং হাত জোড়ে রইলো। বুঝাই যাচ্ছিলো এরা মুসলমান নয়।…..
আমীর আব্দুর রহমান ওদেরকে আরাম করে বসতে বললেন এবং দারোয়ানকে ডেকে ওদের জন্য সেই শরবত নিয়ে আসার জন্য বললেন যা তিনি নিজে পান করে থাকেন।
ওদের সামনে ফল ফুটের স্তুপ্ত এনে রাখা হলো। তারপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, ওরা কি ফরিয়াদ নিয়ে এসেছে? মধ্য বয়স্কা মহিলা গ্রাম্য ভাষায় বললো,
আমাদেরকে সেসব হিংস্র-জঙ্গলীদের অনুগ্রহের ওপর এজন্যই কি আপনি ছুঁড়ে ফেলে ছেন যে, আমরা মুসলমান নই? আমরা কি মানুষ নই?
তার সাথে বসে থাকা এক লোক তাকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বললো, আরে ভদ্রভাবে কথা বলো। ইনি তো বাদশাহ।
আব্দুর রহমান গর্জে উঠে বললেন, আরো ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে কথা বলো। এখানে কেউ বাদশাহ নয়। আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহয্য করবো। সেই হিংস্র আর রক্তলুলুপ জঙ্গী কারা?