পথে-ঘাটে, বাজারে বিচারকের আদালতে ইসলামের অবমাননার যে ফেতনা খ্রিষ্টানরা শুরু করেছিলো সে পথের পথ প্রদর্শক ছিলো এই ফ্লোরাই। রূপের ঐশ্বরিক শক্তি থাকা সত্বেও একটি মেয়ে যখন তার রূপ, যৌবন, জীবনের সব চাহিদাকে বাতিল এক ধর্মের জন্য বিসর্জন দিতে দেখলাম, আমার মধ্যে এ উপলব্ধি জেগে উঠলো যে, আমি কী করছি?
আমি একজন পুরুষ। লোকে আমাকে জ্ঞানী বুদ্ধিমান বলে। অথচ আমিই ওদের হাতের খেলানার পুতুল। আমার ধর্ম বিশ্বাসের কথা মনে পড়লো। লজ্জার তীক্ষ্ম ফলা আমাকে জর্জরিত করতে লাগলো। তখনই আমার চিন্তা-ভাবনায় এক বিপ্লব অনুভব করলাম।…..
আমি মুখে মুখে ফ্লোরা ও ইউগেলিসকে নিশ্চয়তা দিলাম যে, আমি ওদের সাথেই আছি। কিন্তু মনে মনে কসম খেলাম, আর এক মুহূর্তও ওদের সঙ্গে নয়। আমি ফিরে এলাম। বেশ কয়েকবার ভাবলাম, তোমাকে বলি ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও।…
কিন্তু ইউগেলিসকে কেন্দ্র করে যে স্বপ্ন-সাধ তোমার মনে তুমি লালন করে যাচ্ছো সেই অলীক জগৎ থেকে তোমাকে যে বাস্তবতার জগতে ফিরিয়ে আনতে পারবো না এটাও তখন নিশ্চিত হয়ে গেলাম। আমি নীরব রইলাম আর তুমি স্বপ্ন দেখতে লাগলে। ফ্লোরা তার মিশন নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।……
আমার কাছেও ওর সব তৎপরতার খবর নিয়মিত বিরতিতে আসতে লাগলো। তোমার হয়তো মনে আছে এর মধ্যে কতগুলো বিদ্রোহ হয়েছে এবং সবগুলোই দমন করা হয়েছে। খ্রিষ্টানরা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। সন্ত্রাসীদের পাইকারি দরে হত্যা করা হয়েছে।…..
অল্প বয়স্কা সুন্দরী মেয়ে মরিয়ম। সে গির্জার নান হয়ে যায়। ফ্লোরা সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। মরিয়মের এক ভাই পথে ঘাটেপ জন সম্মুখে ইসলাম ও মুসলমানদের গালিগালাজ করতে থাকে। তাকে ধরে বিচারকের আদালতে পেশ করা হয়। বিচারে তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হয়।…
***
মরিয়ম তখন ডাকিনীর বেশে গির্জা থেকে বের হয়ে ইসলাম ও উন্দলুসের প্রশাসনের বিরুদ্ধে নতুন করে তৎপরতা শুরু করে। আদালত তখন ফ্লোরা ও মরিয়মকে গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি করে।
ওদরেকে খুঁজে বের করার জন্য গোয়েন্দা ও সরকারি সোর্সদেরকে জরুরি নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ওদেরকে খুঁজে পাওয়া এত সহজ ছিলো না। বারবারই গোয়েন্দাদের বিছানো জাল ছিন্ন ভিন্ন করে ওরা বেরিয়ে যায়।
সুলতানা নির্বাক হয়ে শুনছে। আর যারিয়াব অবিরত বলে যাচ্ছে।
একদিন এক লোক আমার সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করলো। সে আমাকে ইউগেলিসের পয়গাম দিলো। ইউগেলিস কাছেরই একটি গ্রামে আমার অপেক্ষায় আছে। রাতে আমি ওখানে চলে গেলাম। ইউগেলিস সাক্ষাতে বললো, ওদের বিদ্রোহগুলো একের পর এক ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
ফ্রান্স থেকেও জঙ্গি সাহায্য পাচ্ছে না ওরা। কারণ, আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান সীমান্ত এলাকায় সৈন্যদেরকে খুবই তৎপর রেখেছেন। আর ছোট ছোট গেরিলা দল রাত দিন ঘোড়ায় চরে সীমান্ত এলাকা উত্তপ্ত করে রাখছে।…
আমি ওক জিজ্ঞেস করলাম, এখন সে কী চাচ্ছে? আমাকে ডেকেছে কেন? সে বললো,
আমি এবার কর্ডোভায় বিদ্রোহ করাতে চাচ্ছি। কিন্তু এর সূচনা হবে এভাবে যে, বিদ্রোহ একেবারে শাহী মহল থেকে শুরু হবে। আমীরকে বন্দি করা হবে এবং সব সালারকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে দেয়া হবে। আমি আমার মতো করে চেষ্টা করে গেছি ফৌজের মধ্যে আমার কোন সহযোগি তৈরি করা যায় কিনা। কিন্তু সালাররা প্রত্যেকটা সৈন্যকে এমন ধর্মভীরু বানিয়ে রেখেছে যে, কেউ তার ধর্ম ও দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে বা শুনতে রাজি নয়।…..।
সে আমাকে তখনো তার বন্ধুই মনে করছিলো। আমিও ওকে বন্ধুত্বের থোকা দিয়ে গেছি এবং জিজ্ঞেস করেছি এখন আমাকে কী করতে হবে? ইউগেলিস বললো, সালারদের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিবেন। ওদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করে দিবেন।…..
নায়েবে সালার ও কমান্ডারদের মধ্যে এমন কিছু লোককে হাত করে নিবেন যাদেরকে দিয়ে গৃহযুদ্ধ করানো যাবে। ওদেরকে আমরা এত বেশি সোনা ও টাকা পয়সা দেবো যে, ওরা জীবনেও তা দেখেনি। আপনার ও সুলতানার সাথে আমাদের কৃত প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণই আছে। আপনাদেরকে পৃথক এক রাজ্য উপহার দেয়া হবে। যেখানে চলবে একমাত্র আপনার ও সুলতানার রাজত্ব।……
আমি তাকে বললাম, উন্দলুস থেকে ইসলামের অস্তিত্ব বিনাশে তোমরা সফল হয়ে গেলে তখন তো আমাকে এক পৃথক রাজত্ব দান করবে। কিন্তু সেটাও তো হবে ইসলামী রাজত্ব। সেটার অস্তিত্ব তোমরা কি করে সহ্য করবে? সে বললো,
পুরস্কার স্বরূপ দেয়া ভুখন্ডে যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে সেটার ব্যাপারে আর কোন আপত্তি আমাদের থাকবে না। আমি জানি, আপনি ও সুলতানা যে ভূখন্ডের শাসক হবেন সেটা কেবল নামে ইসলামী রাষ্ট্র হবে। আমার বিশ্বাস, আপনারা দুজন ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিষ্টবাদে দীক্ষিত হয়ে যাবেন।….
তবে এসব অনেক পরের কথা। আপনি যা চাইবেন তাই হবে। সবার আগে আপনি আপনার প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাকে আমাদের স্বার্থে প্রয়োগ করুন। বিদ্রোহ বা গৃহযুদ্ধের জন্য আমাদের ষড়যন্ত্রের জাল কর্ডোভায় বিস্তার করে দিন। যে পরিমাণ সম্পদ আপনার প্রয়োজন হবে আমরা সেটা যোগান দিয়ে যাবো।
ইউগেলিস কথা বলছিলো আর মদ পান করছিলো। কিন্তু আমি মদ একটুও ছুঁয়ে দেখিনি। কারণ, আমার হুশ জ্ঞান আমি ঠিক রাখতে চাচ্ছিলাম। ওখানে তখন ফ্লোরা ও মরিয়মও ছিলো। এই দুই মেয়ের রূপ যৌবনও আমাকে অনেক খানি আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। তবে নিজেকে আমি এক সময় এ থেকে মুক্ত করে নিই। ওদের কাজ করে দেবো বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।