***
আমি অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারি। আমার প্রতি তোমার কোন ভালোবাসা নেই। যারিয়াব বললো, বুঝতে পারি সুলতানা! তুমি আমাকে নিয়ে একটি খেলা খেলছো। কিন্তু আমার পুরো সত্বা তোমার ভালোবাসায় এমন বন্দি ছিলো যে, এ থেকে আমি মুক্ত হতে পারিনি এবং আমি আমার ধর্ম ও জাতির রগ রেশায় ক্রুশের বিষ ছড়াতে থাকি।
আমি স্বীকার করছি, প্রেমের নামে তোমাকে আমি ধোকা দেয়ার চেষ্টা করে গেছি। সুলতানা বললো, কিন্তু আমার ভালোবাসায় তোমাকে দেওয়ানা হতে দেখে আমি নিজেই নিজের ধোকার শিকার হয়ে গেছি। কিছুদিন পরই জীবনের প্রথমবার সেই ভালোবাসার পরম স্বাদ আমি অনুভব করি যা আমার আত্মার গভীর পর্যন্ত শিকড় গেড়ে বসে।….
আমি ইউগেলিসকে বলে দিয়েছিলাম, যারিয়াবকে আমি আর থোকা দিতে পারবো না। ভালোবাসাকে এক খেলা মনে করে ওর নিষ্পাপ আবেগের সাথে আমি আর খেলতে যাবো না।
সুলতানা! আমার ভালোবাসার আর আবেগের চেতনায় এখনো সেই উষ্ণতা আছে যা তোমার যৌবন কালে ছিলো। যারিয়াব বললো, আজো তুমি তোমার জন্য যত বড় ত্যাগ চাইবে আমি স্বীকার করতে পারবো। ভালোবাসার গভীরতা থাকা সত্বেও তুমি যেমন আমাকে অনেক কথা বলোনি তেমন আমারও এমন অনেক কথা আছে যা তোমাকে আমি বলিনি। আজ সেটা শুনে নাও।….
আমি যখন ফ্লোরার কথা শুনি এবং জানতে পারি সেও এক মুসলমানদের মেয়ে হয়েও খ্রিষ্টানদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে তখন ওকে দেখার জন্য আমার মনে বেশ কৌতূহল জন্মালো। কিছু গোয়েন্দা দল আছে প্রশাসনের! কিছু আছে ফৌজের এবং আমারও ব্যক্তিগত ছোট একটা গোয়েন্দা দল ছিলো। এতে হেরেমের দুই সুন্দরী এবং তীক্ষ্ম মেধার দুটি মেয়েও ছিলো।….
ফ্লোরা কোথায় আছে এবং ওকে কিভাবে আমি দেখতে পাবো এটা আমি জেনে নিলাম। একদিন আমাকে জানানো হলো, ফ্লোরা ও ইউগেলিস একটি গ্রামে রয়েছে। কর্ডোভা থেকে সেটা একদিনের পথ। আমি সেদিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
সেই গ্রামে গিয়ে আমার এক বিশেষ লোক দিয়ে গোপনে ইউগেলিসের কাছে খবর পাঠালাম যে, যারিয়াব ফ্লোরা ও তার সঙ্গে সাক্ষাতে এসেছে। গ্রামের অনেকেই আমাকে দেখেছে। কিন্তু কারো এতটুকু সন্দেহ হলো না যে, এই অপরিচিত মুসাফির কর্ডোভার বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পী- যার সঙ্গীত খ্রিষ্টানদের সঙ্গীতকেও সমৃদ্ধ করেছে।
সুলতানা যারিয়াবের কথা বড় মনোযোগদিয়ে শুনছে। এখন আর সে শরাব পানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। যারিয়াব বলে যাচ্ছে,
আমাকে এক পোড়া বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। এমন কামরায় নিয়ে দাঁড় করানো হলো যার ছাদ থেকে মাকড়সার অগণিত জাল ঝুলছে। চার দিকের দেয়ালগুলো ঝুর ঝুরে অবস্থা। আমি ভাবছিলাম এটা কি কোন চাল কিনা। কিন্তু তখনই ইউগেলিস এসে গেলো। বলতে লাগলো,
কর্ডোভার মহান সঙ্গীত শিল্পী কি বলতে পারবেন এত দূরে সফরের কষ্ট কেন স্বীকার করতে গেলেন?
***
আমার আসাটা সে সন্দেহের চোখে দেখলো। আমি বললাম, তোমার বিস্ময়টা অমূলক কিছু নয় ইউগেলিস! এক কৌতূহল আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ। আমি কি আজ পর্যন্ত তোমাকে কখনো ধোকা দিয়েছি? আর থোকা দিতে হলে তো তোমার এখানে আসার আগে অন্য কেউ এসে তোমাকে ও ফ্লোরাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতো। আমি তোমাদের সাথী।
সে জিজ্ঞেস করলো, বন্ধু! কোন কৌতুল আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে?
আমি বললাম, আমি ফ্লোরাকে দেখতে এসেছি। ফ্লোরা যারিয়াবের সুর ছন্দের চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধতায় আচ্ছন্নকারী এবং তার সংকল্প কঠিন শিলা পাথরের চেয়েও মজবুত। ইউগেলিস আমার সাথে আরো কিছু কথা বললো। যখন সে নিশ্চিত হয়ে গেলো ওকে আমি ধোকা দিতে আসিনি আমাকে তখন আরেকটি বাড়িতে নিয়ে গেলো এবং একটি কামরায় বসিয়ে দিলো।
একটু পরই এক যুবতী মেয়ে কামরায় প্রবেশ করলো। ওর রূপ আমাকে বিস্ময়বিস্ট করে ফেললো। সুলতানা! তুমিও যৌবনকালে বিস্ময়কর সুন্দরী ছিলে। সম্ভবত: ফ্লোরার চেয়ে সুন্দরী ছিলে….; কিন্তু ঐ মেয়ের মধ্যে তীব্র এক আকর্ষণই নয়, এক ধরনের সম্মোহন করার মতো যাদুমুগ্ধতা ছিলো। ওর দৈহিক অবকাঠামোটাই প্রেমের জগতে তোলপাড় সৃষ্টি করে দেয়ার মতো। ওর চোখের উজ্জলতার সামনে খুব কম মানুষই টিকতে পারবে।
ইউগেলিস ফ্লোরাকে বললো, ফ্লোরা! এই সেই মহান ব্যক্তিত্ব, শাহী মহলে যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে। ইনি আমাদের জন্য ওখানকার মাটি সমতল করে দিচ্ছেন।
ফ্লোরা এগিয়ে এসে আমার ডান হাতটি তার দুহাতের করোটিতে রেখে চুমু খেলো। তারপর তার বুকে রাখলো এবং তার মুখে যে হাসির ঝলক এলো সেটা আমাকে কাঁপিয়ে দিলো। আমার সন্দেহ হলো, এ কোন দেহ নয়, এ কেবল এক আত্মার প্রতিকৃতি সুলতানা! ফ্লোরা ফুল নয়, ছিলো কলি।
আমি ওকে বললাম, তুমি এত সুন্দরী আর যৌবনবতী কিন্ত তুমি কি করতে পারবে ফ্লোরা! তুমি কি তোমার যৌবন নষ্ট করছো না?
ফ্লো বলে উঠলো, শুনেছি, আপনি এক মহান জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব! কিন্তু আপনার তো এটাও জানা নেই, কিছু করার জন্য দৈহিক শক্তির প্রয়োজন নেই। মানুষ তার বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনায় দৃঢ় হলে তার আত্মার শক্তি জেগে উঠে।
ও যখন তার ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো তখন এই মেয়ে যাকে আমি অন্য দৃষ্টিতে দেখছিলাম আমার চোখে সে পবিত্র এক সত্বা হয়ে ধরা দিলো। ইউগেলিস এও জানালো, মারীদা ও টয়টার বিদ্রোহের আগুন ফ্লোরাই জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।…..