সে বললো, তোমাকে আমি এড়িয়ে যাচ্ছি না সুলতানা। আমার এই মিশনের কারণে তোমার প্রতি আমার অন্যরকম একটা ভালোবাসা আছে। আমি বিয়ে করিনি শুধু এ কারণে যে, তখন আমি শিকলে বাঁধা পড়ে যাবো। আমার মিশনের জন্য আমি বেকার হয়ে যাবে।
তারপর ফ্লোরা আমার মিশনে এক ধ্রুব তারার মতো এসে যোগ দিলো। এক রাতে আমরা এক ঘরে কাটিয়েছি। এক পাদ্রী আমাদেরকে ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলো। ফ্লোরা যখন জানতে পারে, ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য নিজেকে আমি নারী বঞ্চিত রেখেছি তখন সে আমার সাথে অনেক কথা বলে। আমি আশা করিনি এমন সুন্দরী একটি মেয়ে এমন বুদ্ধিমত্তার সাথে কথা বলতে পারে। ওর কথায় আমি নতুন জীবনের স্বাদ অনুভব করি।
ইউগেলিস আমাকে জানালো!, ফ্লোরার ব্যাপারে তার মনে এমন তীব্র এক ভালোবাসা জন্মায় যে, সে তার আর নিয়ন্ত্র করতে পারেনি। দুজন দুজনের কাছে পরস্পরকে সমর্পন করে দেয়। তাদের দুই দেহ এক দেহে পরিণত হয়।
তুমি সম্ভবত জানো না ইউগেলিস ও তার মিশনের পরিণাম কি হয়েছিলো? যারিয়াব বললো।
জানি। সবই জানি।
তুমি হয়তো ওদের দুজনের মৃত্যুর ব্যাপারে জানো, যারিয়ার বললো, কিন্তু তুমি হয়তো জানো না, ওরা ওদের মিশন কিভাবে চালিয়েছিলো। আর নিজের ওপর এক মেয়ের ছায়া নিয়ে ইউগেলিস ধীরে ধীরে কিভাবে বাতিল হয়ে গিয়েছিলো?
***
যারিয়াব অতীতের একটি পর্দা সরালো। বললো,
ঈসা মাসীহের বাদশাহী প্রতিষ্ঠা ও উন্দলুস থেকে মুসলমানদেরকে উৎখাতের জন্য ফ্লোরা তার জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলো। সে তার রূপ যৌবনের আবেগ ভালোবাসা এই মিশনের জন্য বিসর্জন দিয়েছিলো।
সে পাদ্রী বা নান হয়ে যায়। খ্রিষ্টানরা তাকে মরিয়ম ছানী বলে ডাকতে থাকে। খ্রিষ্টানদের পাদ্রীরা রাতে কবরস্থানে ধোয়ার ভেতর থেকে ফ্লোরাকে বের করে সাধারণ মানুষের চোখে ভেল্কি লাগিয়ে দেয়।
এভাবে তাকে খ্রিষ্টানরা মরিয়ম ছানী বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। খ্রিষ্টানরা এসব ধোঁকাবাজি করে টয়টা ও মারীদায় দুবার বিদ্রোহ করায় এবং এতে হাজার হাজার খ্রিষ্টান মারা যায়। অগণিত লাশ ছাড়া ওদের আর কোন অর্জন কি হয়েছে? হয়নি!
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বারের মতো মুসলমানদেরকে ওরা ধোঁকা দিয়ে ওদের দলে ভিড়িয়ে নেয়। আর এদিকে তুমি আমীরে উন্দলুসকে যে কোন অভিযানে যাতে না যায় এজন্য সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হও। কখনো কখনো আমাকেও তোমার সঙ্গ দিতে হয়। কিন্তু…..
কিন্তু মুদ্দাসসিরা আমীরে উন্দলুসের ওপর যাদু চালিয়ে তাকে সুলতানা বললো।
শুধু মুদ্দাসসিরা নয়। যারিষাব সুলতানাকে থামিয়ে দিয়েবসলো, আব্দুর রহমানকে তার সালাররাই মরণ ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। আর মুদ্দাসসিরা তোমার বিছানো ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করে। সেই জাগরণকে মর্দে মুজাহিদে পরিণত করে। মুদ্দাসসিরা সত্যিই ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে নিয়েছে।…..
আর সালারদের ঈমান সময় দৃঢ় ছিলো বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তাদের ঈমান এজন্য মজবুত ছিলো যে, উন্দলুসের মাটিতে শহীদ হওয়া পূণ্যত্মাকে সবসময় তাদের স্মৃতিতে প্রাণময় রেখেছে তারা। যারা উন্দলুসকে জয় করেছে। যারা নিজেদের রক্ত ঢেলে কাফেরদের বুকে ইসলামের ঝান্ডা উড়িয়েছে। তুমি তো জানোই, সালাররা কিভাবে আমীরে উন্দলুসকে তোমার কজা থেকে মুক্ত করে!
তুমিও কি ফ্লোরাকে আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী মনে করো? সুলতানা যেন নেশার ঘোরে কথা বলে উঠলো।
আমি কাকে কি চোখে দেখি সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। যারিয়াব বললো, তুমি আমার কাছে অতীতের কথা শুনতে চেয়েছো যখন তোমার রূপ ও তার যাদুতে যৌবনের তীব্রতা ছিলো। আমাকে অতীতের পর্দাগুলো তাই একটু একটু করে সরাতে দাও।…….
আমি নিজেই তো তোমার ভালোবাসায় বন্দি হয়ে খ্রিষ্টানদের হাতে খেলতে শুরু করি। তুমি তোমার জায়গীরে যার বাগানও তোমার মতোই সুন্দর ছিলো ওখানে ইউগেলিসের সাথে আমার সাক্ষাৎ করাও।….
ওতো কোনো দরবেশের ছদ্মবেশে এসেছিলো সেদিন। তোমার প্রেম আমাকে অন্ধ করে রেখেছিলো বলে আমি বুঝে উঠতে পারিনি কি করতে যাচ্ছি। ইউগেলিস আমাকে বলে, আরব থেকে আসা ঐ মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতি বদলে দাও। আর তোমাকে বলে উন্দলুসের সিংহাসন উল্টে দিলে তোমাকে বিশাল এক রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবে। আমি হবো তার বাদশাহ।….
তোমার প্রেম আর আমার সুর ছন্দ যা তোমার প্রেমের ফসল ছিলো সেটা আমাকে এক ঘোরলাগা জীবনে নিয়ে যায়। এই স্বপ্নও আমার বোধ-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখে যে, তুমি হবে সম্রাজ্ঞী আর আমি হবো তোমার স্বামী।….
আমি আমার মেধা, মুখের ভাষা ও বিষয়জ্ঞানের যাদু দিয়ে শাহী দরবারে প্রভাবশালী এক পদ অধিকার করে নিই। সবার জন্য আমি এক দৃষ্টান্ত হয়ে যাই। আরবীয় শাসক শ্রেণীর জীবন-যাপন, আবাস ভবন, পোশাক-আশাক এমন কি চুলের মধ্যেও বিধর্মী ইউরোপীয়ানদের সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিই। মুসলিম উমারাদের মেয়েদেরকে এমন পোশাকে সুসজ্জিত করি যে, ওদের পর্দা ব্যবস্থা নামমাত্র রয়ে যায়।…….
ইউগেলিস বলতো সৈন্য আরও অস্ত্র দিয়ে বিজয় অর্জিত হয় না। সুলতানা বললো, সুনিপুন কৌশলে এবং মায়াজাল বিস্তার করে কোন জাতির আবাস-ভবন, সভ্যতা, সংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, সামাজিকতা ইত্যাদি তোমার মতো করে বদলে দাও। দেখবে সে জাতিকে খুব সহজেই তুমি জয় করে নিতে পারবে।