তুমি কি আমাকে একটু ভালো ভালো কথা শোনাতে পারো না? সুলতানা কিছুটা চাপা অসন্তোষ নিয়ে বললো, তুমি তো আমার কাছে এসে এই জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যেতে। এখন কি আর আমার প্রতি সেই ভালোবাসা নেই?
আগের চেয়ে অনেক বেশি আছে। যারিয়ার বললো, কিন্তু সে সময়টা আমরা অতীত করে এসেছি যে সময়তে আর ফিরে যেতে পারবো না। সে সময়ের জন্য আক্ষেপ করাটা অনেক বড় বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমার এই ভয়াবহ দুশ্চিন্তার কারণ হলো, সময় এগিয়ে যাচ্ছে আর তুমি পেছন দিকে পালানোর পথ খুঁজছে। অধরা অতীতকে ভুল যাও সুলতানা! যে মুহর্তগুলো তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছে তা থেকেই শান্তির পরশ খুঁজে নাও।
হা যারিয়াব! সুলতানা বললো, তুমি হেয়ালি করলেও এটা ঠিক যে, আমি হারানো দিনে পালিয়ে যেতে যাচ্ছি। অতীতের মায়াজাল থেকে বেরোতে চাচ্ছি না আমি। আগের মতো রূপসী না থাকলেও রূপমা, স্মৃতি আর কল্পনা দিয়ে নিজেকে রূপবর্তী করে রাখবো।…
নিঃসঙ্গতা আমাকে দংশন করে যাচ্ছে। অজানা এক ভয় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আগের রূপ নিয়ে আমার সাথে কথা বলো যারিয়াব। তোমার কাছে তো শব্দের ভান্ডার আছে। শব্দের ওপর বহন করে আমাকে অতীতে নিয়ে চলো।….
তোমার সুঠাম বাহুতে কি সেই শক্তি নেই যারিয়াব? আমাকে একটু শক্ত করে ধরছো না কেন? আমার মনের মধ্যে কমপক্ষে এটা ঢুকিয়ে দিয়ো না যে, আমি এক ঝরে যাওয়া শুকনো ফুল; গাছের ছায়ায়ও যার আশ্রয় নেই।
তোমার এই শরীর সর্বস্ব মনমাসকিতা থেকে কি তুমি মুক্ত হতে পারো না? যারিয়াব বললো, নিজের ভেতরের আত্মাকে জাগিয়ে তোলো। দেহের বার্ধক্য আত্মার যৌবন নিয়ে আসে। আমি আমার দেহের শক্তিকে আত্মায় বহন করে নিয়েছি।
সুলতানা ভীতু শিশুর মতো যারিয়াবের বুকে লুকাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু যারিয়ার উঠে দাঁড়ালো।
তুমি মিথ্যা আশ্রয় খুঁজছে। গতকালের স্মৃতিকে আকড়ে ধরে আজকের বাস্তবতা থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। নিজের মেধা আর বুদ্ধিকে তার আসল ঠিকানায় প্রয়োগ করো। তারপর আমি তোমার সাথে অতীতের কথা বলবো।
এক পেয়ালা শরাব পান করার পর সুলতানার যৌবন আবার যেন ফিরে এলো। তার অঙ্গ-ভঙ্গি আবার আবেদনময়ী হয়ে উঠলো। দুহাতে যারিয়াবের গলা জড়িয়ে ধরলো।
যারিয়াব! আমি তোমার দাসী! সুলতানা কাতর কণ্ঠে বললো। একমাত্র তুমিই আমাকে মন থেকে ভালোবেসেছে। আমি আমীরে উন্দলুসকে এতটুকু সন্দিহান হতে দেইনি যে, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুশমন ইউগেলিসের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আর আমি তার সিংহাসন উল্টানোর চেষ্টা করেছি সব সময়। কিন্তু তোমর বিরুদ্ধে আমার সব সময় এ অভিযোগ ছিলো যে, এ কাজে তুমি আমাকে অতটা সঙ্গ দাওনি।
আমি সঙ্গ দিলেও তুমি ও ইউগেলিস কখনো সফল হতে না। আমি পঁচিশ বছর আগে আমার বিবেক আমি এজন্য পরিস্কার করে নিই যে, বার্ধক্যে পৌঁছে যেন আমি অনুতপ্ত ও লজ্জাবতন না হই। এর পরিণামেই আজ আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত এবং ভারমুক্ত।
যারিয়াব সুলতানার হাত থেকে শরাব নিয়ে এক ঢোক পান করে পাত্রটি রেখে দিলো। তার মাথার চুলেও কোথাও কোথাও পাক ধরেছে। কিন্তু এই বয়সেও সে সুলতানাকে আগের মতোই ভালোবাসে।
***
৯. পুরনো একটি কথা
পুরনো একটি কথা আমার মনে পড়েছে। সুলতানা বাচ্চা মেয়েদের মতো কল কল করে বলে উঠলো, ফ্লোরার কথা তোমার মনে আছে না? আমি ওকে মাত্র একবারই দেখেছিলাম। অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে। একদিন আমি আমীরে উন্দলুসকে বলেছিলাম, ফ্লোরাকে আপনি উঠিয়ে আনুন বা ওকে কিনে নিন এবং আপনার হেরেমে রেখে দিন। তোমাকে অবশ্য আমি কখনো একথা জানাইনি আমি।…..
ফ্লোরা আমীরে উন্দলুসের কাছে এলে তোমার অবস্থান আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসতো। ফ্লোরা বয়সে তোমার চেয়ে কম ছিলো এবং রূপসীও ছিলো এমন, যে কাউকে হতভম্ব করে দেয়ার মতো। আমীরে উন্দলুস ওকে পেলে তো পাগল হয়ে যেতেন। তুমি আমীরে উন্দলুসকে এ ধরনের কথা কেন চলেছিলে! তাঁকে খুশি করার জন্য?
না সুলতানা বললো। তাকে পাগল বানানোর জন্য। আমার পরিকল্পনা ছিলো ফ্লোরা হেরেমে এসে গেলে আমরা দুজন মিলে আমীরে উন্দলুসকে আমাদের জালে জড়িয়ে ফেলতাম। এভাবেই আমার উদ্দেশ্য পূরণ হতো।…..
এক রাতে আমি ইউগেলিসকে আমার জায়গীরের ডেকে ছিলাম। আমি তাকে বললাম, আমীরে উন্দলুস আবার ময়দানের এক লড়াকু মুজাহিদ হয়ে যাচ্ছেন।…..
তাঁর সবচেয়ে ছোট স্ত্রী মুদ্দাসসিরার কথায় তিনি এখন সবকিছু করেন। ফ্লোরা হেরেমে এসে গেলে আমরা দুজনে মিলে আমীরকে আবার আমাদের জাদুর জালে জড়িয়ে ফেলবো। ইউগেলিস আমার কথা মানলো না। সে ফ্লোরাকে অতি পবিত্র মেয়ে মনে করে।……
সে বললো, হেরেমে গিয়ে সে শুধু অপবিত্রই হবে না, সেখানকার ভোগবিলাসী জীবন পেয়ে সে তার কুরবানী দেয়ার জীবনের কথা ভুলে যাবে। তারপর আমার তোমার সব গোপন কথা আমীরে উন্দলুসের কাছে ফাঁস করে দেবে।
তুমি তো জানোই, সে আমার সাথে ওয়াদা করেছিলো, আমাকে ও তোমাকে কোন বিশাল প্রদেশের সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবে। তার ইশারাতেই তো আমি নাচতাম। কিন্তু সে তার মিশনকে এতই পবিত্র মনে করতো যে, আমার কথার কোন গুরুত্ব দিলো না।
আমি রেগে গেলাম। ইউগেলিসের ওপর মদের প্রভাব ছিলো তখন। আমার ক্ষুদ্ধতাও তাকে বেশ নাড়া দিয়েছিলো। তার মিশন সফল করার জন্য আমি অনেক কিছুই করতে পারতাম এবং করেছিও। তাই সে আমাকে অসন্তুষ্ট করতে চাইলো না।…..